কাদিয়ানী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী (১৮৩৫-১৯০৮) ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গুরুদাস পুরের কাদিয়ান নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি স্ববিরোধী কিছু দাবীর মাধ্যমে নিজেকে একটি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসে তার মত আরো অনেকে এভাবে বহু মতবাদ এনেছেন। শিয়া, বাহাই, ইসমাইলীয়া সম্প্রদায় সহ বিশটির অধিক মতবাদ এখনও দুনিয়াতে বিদ্যমান রয়েছে। তবে তারা কেউ কাদিয়ানীদের মত এতটুকু সমস্যা নিয়ে হাজির হয়নি। যার কারণে প্রতিটি সচেতন মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে তারা গ্রহণযোগ্য হয়নি বরং তাদের অবস্থান মুসলিম সমাজে নিত্য নতুন সমস্যা তৈরি করে চলছে।
মির্জা গোলাম আহমেদ নিজেকে কখনও ‘নবী’ কখনও ‘মসীহ’ কখনও ‘ইমাম মাহদী’ দাবী করেছেন। এখানে মসীহ আর মাহদী এক চরিত্র নয়। মসীহ হলেন ঈসা (আঃ) এবং তিনি একজন রাসুল। ইমাম মাহদী হবেন একজন জগৎবিখ্যাত ঈমাম যিনি দুনিয়াতে আসবেন। ইসলামের ইতিহাসে ইমাম বুখারী, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম গাজ্জালী সহ বহু ইমাম গত হয়েছেন। তাঁদের কাছে কখনও ওহী আসেনি এবং তারা কোন নতুন শরীয়তও ঘোষণা করেন নি। তাঁরা বরং কোরআন হাদিসের আলোকে আধুনিক সমস্যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইমাম মাহদীও সে ধরনের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হবেন, যার কাছে নবী-রাসুলের মত ওহী আসার সম্ভাবনা নাই। মির্জা গোলাম আহমেদ আবার দাবী করেছেন তার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী এসেছিল। যুক্তির খাতিরে যদি ধরা হয়, তার কাছে ওহী আসে। তাহলে তিনি আর কোন অবস্থাতেই ইমাম মাহদী হতে পারেন না। ইসলামের মৌলিক দাবী হল মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর শেষ নবী ও রাসুল, তাঁর পরে পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবেন না। যদি কোন নবী আসতেন তাহলে হযরত ওমরকেই আল্লাহ নবী করে পাঠাতেন। সুতরাং মির্জা গোলাম আহমেদ যে নবী নয়, তা রাসুল (সাঃ) এর এই হাদিসে প্রমাণিত হয়। আবার তিনি কখনও নিজেকে মসীহ হিসেবে দাবী করেছেন। অথচ মসীহ হলেন ঈসা (আঃ) এবং তিনি একজন রাসুল ছিলেন। মসীহের মর্যাদা অর্থাৎ একজন রাসুলের মর্যাদার সাথে ইমাম মাহদী তথা একজন ইমামের মর্যাদা কিভাবে তুলনা করা যায়? যেখানে দুটোর মর্যাদাই তুলনা করা যায়না সেখানে মির্জা গোলাম আহমেদ, সেই দুটি চরিত্রই নিজের বলে দাবী করেছেন! সুতরাং তার প্রতিটি দাবী একটির সাথে অন্যটি সাংঘার্ষিক এবং সরাসরি স্ববিরোধী। অথচ পৃথিবীর কোন রাসুল এবং নবীদের কথা বার্তার একটি অক্ষরও স্ববিরোধী এবং সাংঘার্ষিক ছিলনা। এই স্ববিরোধিতার যাঁতাকলে পড়ে কাদিয়ানীরা ও দ্বিধা বিভক্ত। পাকিস্তানের কাদিয়ানীরা বলেন তিনি একজন ইমাম ছিলেন, ভারতীয় কাদিয়ানীরা বলেন তিনি একজন নবী ছিলেন, বাংলাদেশের কাদিয়ানীরা বলেন মোহাম্মাদ (সাঃ) কে তারাও নবী হিসেবে মানে। মূলত প্রতিকূল অবস্থা সামাল দিতেই কাদিয়ানীরা এই পদ্ধতির অবলম্বন করে।
নবী রাসুলদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত কয়েকটি মৌলিক দিকের কথা না বললে লেখাটির তাৎপর্য বুঝা যাবেনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবী রাসুলদের জন্য দুনিয়ার কোন ব্যক্তিকে শিক্ষক বানায় নাই। জিবরাঈলের (আঃ) মাধ্যমে আল্লাহ নবীদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে মির্জা সাহেব পুরো বাল্যকালেই বিভিন্ন মক্তব, খৃষ্টান মিশনারি থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। আল্লাহ কোন পরাশক্তির কাছে নবীদের রিজিকের ব্যবস্থা করে নাই, আল্লাহ বিরোধী কথা বলার কারণে শিশু মুসা (আঃ) ফেরাউনের গালে প্রচণ্ড থাপ্পড় মেরেছিলেন। অথচ মির্জা গোলাম আহমেদ রিজিকের তাড়নায় ব্রিটিশের অধীনে দীর্ঘদিন কেরানীর চাকুরী করেছেন। যাদের অধীনে চাকুরী করে জীবন ধারণ করা নবী তো বহু দূরের কথা, একজন ইমামের জন্যও হারাম। সম সাময়িক খোদা-দ্রোহী শক্তির বিরুদ্ধে নবী রাসুলদের পাঠানো হয়েছে, আর নবীরা সেই শক্তিকে উৎখাত করে আল্লাহর বিধান কায়েম করেছে। মির্জা সাহেবের আমলে চরম খোদা-দ্রোহী শক্তি ছিল ব্রিটিশ। তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি বরং অনুসারীদেরকে ব্রিটিশের গোলামী করার জন্য খোদার পক্ষ থেকে ওহী জোগাড় করে এনেছেন। উপরের তিনটি ধারার কোনটিতেই মির্জা গোলাম আহমদের পরিষ্কার অবস্থান ছিলনা। তাই কোন যুক্তিতেই তাকে নবী, রাসুল কিংবা ইমাম মানার কোন সুযোগ নাই।
ব্রিটিশেরা ভারতে মুসলমানদের থেকেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল। নবাব সিরাজদ্দৌলার পতনের পরও মুসলমানদের নিকট থেকে পরিপূর্ণ ক্ষমতা কেড়ে নিতে আরো একশত বছর লেগেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব মূলত মুসলমানেরাই ঘটিয়েছিল। সেই বিপ্লবের ফলে হাজার হাজার মুসলিম আলেম শাহাদাত বরণ করেন। যার কারণে মুসলমানদের নিয়ে ব্রিটিশ তেমন স্বস্তিতে ছিলনা। ফলে এসব সমস্যা পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটিশ সরকারকে পরামর্শ দিতে, স্যার উইলিয়াম হান্টার (১৮৪০-১৯০০খৃ) কে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করে ভারতে পাঠানো হয়। হান্টার কমিশন ব্রিটিশ সরকারকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিল তার মধ্যে একটি বড় অধ্যায় ছিল মুসলমানদের কে নিয়ে। তিনি তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ বইয়ে স্বীকার করেছেন, ‘যখন আমরা অস্ত্রবলে মুসলমানদের নির্মূল করতে চেয়েছি, তখন তারা আমাদের নেতাদের হতবুদ্ধি করে দিয়েছে এবং আমাদের সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে’। তিনি অন্যত্র বলেছেন ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জন্য মুসলমানেরা হল স্থায়ী বিপদ স্বরূপ’। হান্টার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, "ভারতীয় মুসলমানরা কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে। তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরআনেই নির্দেশ রয়েছে বিজাতীয়দের শাসন মানা যাবে না এবং শাসকদের জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে জিহাদ করতে হবে”। কমিশন বুঝতে পারেন জিদাহী চেতনার কারণেই মুসলমানদের পর্যদুস্ত করা যায়নি এবং কোনভাবে তাদের মধ্যে বিবাদ ঢুকিয়ে দিতে পারলে তারা হীনবল হয়ে পড়বে। হান্টার কমিশন মুসলমানদের এই প্রেরণা কিভাবে নষ্ট করা যাবে সে সম্পর্কে একটি সুপারিশও পেশ করেছিলেন। তিনি সুপারিশ করেছেন, "ভারতের মুসলমানদের বিরাট সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশ পীর ভক্ত। তাই মুসলমানদের মধ্য হতে আমাদের আস্থা-ভাজন এমন একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে দাঁড় করাতে হবে, যিনি বংশ পরম্পরায় আমাদের আস্থা-ভাজন বলে প্রমাণিত হবেন এবং মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিতে সহযোগিতা করবেন”।
উপরের তথ্যগুলো হল ইতিহাসের পাতা থেকে তোলা। ব্রিটিশ সরকার সর্বদা এ ধরণের একজন ব্যক্তির সন্ধানে ছিলেন। অবশেষে তারা তাদের ইচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য তাদেরই অধীনে কেরানী হিসেবে চাকুরীরত মির্জা গোলাম আহমেদকে পেয়ে যান। অর্থ কড়ির লোভ, পদের প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে কিনতে পারা ব্রিটিশ পলিসির অন্যতম দিক। ইরাকের আইয়াদ আলাভী, নুরী আল মালিকি, হামিদ কারজাই, ড. ফখরুদ্দীন দের মত মানুষকে তারা পালন করেই পরবর্তীতে কাজে লাগিয়েছিল। সেভাবেই তারা মির্জা গোলাম আহমেদকে কাজে লাগানোর জন্য এক অভিনব পন্থা বের করে। ইসলাম ধর্মের মাঝে বিভেদ, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দীর্ঘদিন তাকে জিইয়ে রাখার মত এমন এক পন্থা আবিষ্কার করেন যা আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়ে আছে। পৃথিবীর ইতিহাসে যত নবী-রাসুল এসেছেন তারা মানুষকে আল্লাহর পথে ডাক দিয়েছেন এবং সে অঞ্চলের মানুষের ভাষা অনুযায়ী কিতাব এনেছেন, স্থানীয় ভাষাতেই মানুষকে আল্লাহর প্রতি আহবান করেছেন। এক্ষেত্রে মির্জা গোলাম আহমেদ ভারতে জন্ম নিলেও তিনি তার দাবী অনুযায়ী ওহী এনেছেন আরবি ভাষায় অথচ তা হবার কথা ছিল হিন্দি কিংবা উর্দু ভাষায়। আরো আশ্চর্য যে, তিনি হাদিসের স্টাইলে যত বক্তব্য দিয়েছেন তা আরবি ভাষায় না হয়ে, বেশীর ভাগই উর্দু ভাষায় দিয়েছে। তার অনুসারীদের মাঝে পরবর্তী জীবনে কাউকে আর আরবি ভাষায় দক্ষ পাওয়া যায়নি। কোন নবীরা এমন কাজ করে নাই, এমনকি কোন ইমামেরা পর্যন্ত এ জাতীয় কুটিল পদ্ধতির আশ্রয় নেয় নাই। অথচ মির্জা গোলাম আহমেদ এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, ইসলাম ধর্মকে দুর্বল, আভ্যন্তরীণ গোলযোগ বাড়িয়ে দেবার প্রত্যয়ে এবং ব্রিটিশের সরকারের সহযোগিতায়।
সকল নবীরা এক আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেও তাঁদের ভাষা, শব্দ প্রয়োগ এবং পরিভাষা ছিল ভিন্ন, তবে সকল নবীদের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। যেমন, মুসলমানেরা যাঁদের ‘আদম-হাওয়া’ বলে খৃষ্টানেরা তাকে 'এডাম-ইভ' বলে। মুসলমানেরা যাকে জান্নাত-জাহান্নাম বলে ইহুদী-খৃষ্টানেরা সেসব বিশ্বাস করলেও অন্য নামে চিনে। মুসলমানেরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনার্থে যাকে মসজিদ বলে, খৃষ্টানেরা তাকে গির্জা বলে, ইহুদীরা তাকে সিনাগগ বলে। ইহুদীর ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্ট হিব্রু ভাষায় রচিত, খৃষ্টান ধর্মগ্রন্থ সুরীয়ানী ভাষায় রচিত আর পবিত্র কোরআন আরবি ভাষায় রচিত। এসব কিতাব এক আল্লাহর নিকট থেকে উৎসারিত হলেও, কোন কিতাবের পরিভাষা এক ধরনের ছিলনা। ফলে এসব ধর্মের মানুষ আলাদা বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব নিয়ে, পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে মুসলিম দেশে বাস করে আসছে। তবে মির্জা গোলাম আহমেদ এক্ষেত্রে এক নতুন ফন্দির আশ্রয় গ্রহণ করে। যেমন, তার কিতাবের কথাগুলোকে কোরআনের কথা বলা হয়। তার বর্ণিত কথাগুলোকে হাদিস বলা হয়। তাদের নির্মিত উপাসনালয়কে মসজিদ বলে, তাদের মত করে পালন করা প্রার্থনা কে নামাজ বলে। তাদের উপোষ করার পদ্ধতিকে উপবাস ব্রত, চীবর দান, ফাষ্টথিং কিংবা নতুন নামে না ডেকে বলা হয় রোজা রাখা হয়েছে! গোলাম আহমদের আনিত ধর্ম নতুন এবং তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক নাগরিক হওয়া স্বত্বেও হিন্দি ভাষার প্রাধান্যের জায়গায় আরবি ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছে। মুসলমানদের রেওয়াজ অনুসারে আরবি শব্দ আল্লাহকে, তিনিও আল্লাহ বলেছেন; নবীদের কে তিনিও নবী বলেছেন। সেভাবে জিবরাঈল, মিকাঈল, ইসরাফিল, নাজিল, নফল, ফরজ, আসমান, ফেরেশতা, জান্নাত, জাহান্নাম, সাওম, সালাত, ইমান থেকে শুরু করে ইসলামী যত পরিভাষা আছে সকল পরিভাষা তার ধর্মের জন্যও ব্যবহার করেছেন। অথচ এসব শব্দ ও পরিভাষা আরবি এবং ইসলাম ধর্মের জন্যই ব্যবহৃত হয়। অথচ তার নতুন ধর্মের জন্য শব্দ, বাক্য, পরিভাষা অবশ্যই হিন্দি হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। এসব শব্দ আরবি হওয়া সত্ত্বেও, তিনি তা হিন্দিভাষী ভারতীয়দের মাঝে ঢুকাতে চেষ্টা করেছেন। ইসলাম পরবর্তী সময়ে আরো বহু ধর্মের জন্ম হলেও, তারা আলাদা স্বতন্ত্রতা নিয়ে গড়ে উঠেছে। আল্লাহ যদি ভারতীয় এলাকায় কোন নবী পাঠাতেন, তিনি হিন্দি ভাষায় কথা বলতেন, তাঁর আনিত কিতাব হিন্দি ভাষায় হত এবং ইবাদত বন্দেগীর জন্য হিন্দি ভাষায় নতুন পরিভাষা সৃষ্টি হত। গোলাম আহমদের আনিত ধর্মে সেটা কোথাও পরিলক্ষিত হয়নি বরং তিনি ইসলাম ধর্মের সকল কিছু ধারণ করে, ইসলামী অনুশাসনে অভ্যস্ত মানুষদের পথভ্রষ্ট করার নীতি গ্রহণ করেছে, এটি একটি মহা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। উল্লেখ্য আশির দশকে খৃষ্টান মিশনারিরা বাইবেল কে বঙ্গানুবাদ করতে, কোরআনের পরিভাষা গ্রহণ করেছিল। তারা ইঞ্জিল শরীফ নাম দিয়ে বাইবেল ছেপেছিল। আমি ইঞ্জিল শরীফ নামক সেই বাইবেল নিয়ে তাদের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া করেছিলাম। তাদের সার্টিফিকেট সহ সেই ইঞ্জিল কিতাব এখনও আমার সংগ্রহ শালায় আছে। তবে অজানা কারণে খৃষ্টানেরা সেই পদ্ধতি নিজেরাই বাতিল করে ইংরেজি পরিভাষায় বাইবেল প্রকাশ করে। কাদিয়ানীদের কু-মতলব ছিল বলে, আরবি পরিভাষা ত্যাগ না করে, সেটাকে বিভ্রান্তির পূঁজি বানিয়েছে! সমস্যাটা এখানেই।
কাদিয়ানী ধর্মের সকল পরিভাষা যেহেতু ইসলাম থেকে নিয়েছে সেহেতু অল্প শিক্ষিত মুসলমানেরা কাদিয়ানীর কিতাব আর ইসলামী কিতাবের পার্থক্য ধরতে পারে না। কম জানা সে সকল মুসলমান আন্তরিকতার সাথে মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক হাদিসের জ্ঞান মনে মনে করে কাদিয়ানীর কিতাব পড়ে থাকে। কাদিয়ানী কিতাবের কথা বিশ্বাসের কারণে একজন অসহায় মুসলমান জানতেই পারবেনা কখন তার ঈমান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জিহাদ সম্পর্কিত হান্টারের পরামর্শ অবিকল আমল করেছেন মির্জা গোলাম আহমেদ। তিনি মুসলমানদেরকে জিহাদের প্রেরণা থেকে দূরে রাখতে লিখনির মাধ্যমে সেই কাজ সফলতার সহিত আঞ্জাম দিয়েছেন। জিহাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত গোলাম আহমেদ নিজেই বলেছেন, ‘আমি জিহাদের বিরুদ্ধে এত লিখেছি যে, সে সব যদি জমা রাখা হত, তাহলে ৫০ টি আলমারি লাগত হেফাজতের জন্য’। কাদিয়ানীরা লোক দেখানো, দৃশ্যত আকর্ষণীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মানুষকে দাওয়াত দেয়। যেমন, এস ভাল মুসলমান হই, আসুন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে উঠি ইত্যাদি। এসব চটকদার সুন্দর কথায় সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হয় এবং বিস্তারিত না জেনে তাদের সাথে ভিড়ে যায়। তাদের প্রতি উৎসাহী মানুষদের মাঝ থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে প্রলোভনে ফেলা হয়। কাউকে বৃত্তির প্রলোভন, কাউকে বিদেশী ডিগ্রীর লোভ, উচ্চতর ডিগ্রী পাইয়ে দিতে সহযোগিতার আশ্বাস, বেশী বেতনের চাকুরীর প্রস্তাব, বিদেশী কোম্পানির বড় পদ ভাগিয়ে দেবার লোভ সহ নানাবিধ ভাবে মানুষকে ঘায়েল করা হয়। মানুষকে সাহায্যের নামে ঈমান বরবাদ করা, মুসলিম দেশে মুসলিম নাম নিয়ে বেশী সুবিধা আদায় করা, মুসলমানদের হীনবল করা, নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা এবং মুসলমান ছপ্দনামে খৃষ্টান বিশ্বের জন্য বিশ্বস্ত গুপ্তচর বাড়ানো মূলত এই ধর্মের অন্যতম প্রধান কাজ। এই ধর্মের মূল পরিকল্পনা দাতা হল ব্রিটিশ সরকার, যার ফলে তাদের সকল প্রকার সাহায্য সহযোগিতার উপর ভিত্তি করেই পৃথিবীতে এই ধর্মের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনকে রক্ষা ও ব্রিটিশকে আজীবন সেবা করার জন্য গোলাম আহম্মদ কাদিয়ানী তার উম্মতদের কে বহু যায়গায় প্রচুর উপদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, “শুন, ইংরেজদের রাজত্ব তোমাদের জন্য একটি বরকত এবং খোদার তরফ হইতে তাহা তোমাদের জন্য ঢাল স্বরূপ। অতএব তোমরা নিজেদের জান প্রাণ দিয়া ঢালের যত্ন কর, হেফাজত কর, সম্মান কর। আমাদের বিরোধী মুসলমানদের তুলনায় তারা হাজার গুনে শ্রেষ্ঠ”। তবলীগে রিসালাত, ২য় খণ্ড, ১২৩ পৃষ্ঠা।
কাদিয়ানীদের এসব কর্মকাণ্ডের কারণে শুরু থেকই এই মতবাদের বিরুদ্ধে মুসলমানেরা প্রতিবাদ করেছে। বহু বিতর্ক সভা হয়েছে সর্বত্র তারা পরাজিত হয়েছে। কয়েকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে। প্রত্যেক বারই ব্রিটিশ সরকার তাদের রক্ষার্থে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশ সরকার মুসলিম এবং কাদিয়ানীদের সংঘাতের মধ্যে বরাবরই কাদিয়ানীর পক্ষ নিয়েছে। পরবর্তীতে ব্রিটিশের অনুসরণে কাদিয়ানীদের কে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ সকল খৃষ্টান সম্প্রদায় তাদের পক্ষ নিতে কসুর করেনি। অন্যদিকে কাদিয়ানীদের বই-পুস্তক, বক্তৃতা-বিবৃতিতে ব্রিটিশের পক্ষে সুনাম গাওয়া থেকে প্রমাণিত হয় মূলত কাদিয়ানীরা ইসলাম ধর্মের ভিতর একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তুলতে সদা সচেষ্ট। তারা ইসলাম ধর্মের ভিতরে থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, তারা নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দেবে এবং পরগাছার মত ইসলাম ধর্মের ক্ষতি করার যতটুকু সম্ভব তার সবটাই করবে। পৃথিবীর ইতিহাসে ধর্মের নামে প্যারাসাইট বা পরগাছা হয়ে নতুন মতবাদ ঢুকানোর জন্য কাদিয়ানীর মত দ্বিতীয় ভয়ঙ্কর কোন উদাহরণ নাই। এসব কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে পৃথিবীর বেশীর ভাগ মুসলিম দেশেই কাদিয়ানীদের অমুসলিম সম্প্রদায় ঘোষণা করে এবং তাদেরকে সে সব দেশে গমন নিষিদ্ধ করা হয়। সকল ধর্মের মানুষ মুসলিম দেশে যেতে পারলেও কাদিয়ানীরা যেহেতু ইসলাম ধর্মের পরগাছা হিসেবে সৃষ্ট, তাদের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সংঘাত বাড়ার সম্ভাবনা বেশী, তাই তাদের মুসলিম দেশে ঢুকাটা নিষেধ করা হয়েছে। এই আইনের কার্যকারিতা রহিত কল্পে ব্রিটিশ সরকার কাদিয়ানীদের জন্য তড়িৎ গতিতে প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করেছে। কাদিয়ানীরা মূলত ভারত ও পাকিস্তান থেকে সৃষ্ট, আর ভারত সরকার হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং ব্রিটিশের কাছে বিশ্বস্ত। ফলে ভারত সরকার তাদের পাসপোর্ট তৈরিতে কাদিয়ানীদের ধর্মের কোন পরিচিতি উল্লেখ না করে মুসলিম হিসেবে লিখে থাকে। ফলে কাদিয়ানীরা ভারত থেকে যে কোন মুসলিম দেশে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়ে যায়। মুখে দাড়ি, নামে মুসলমান সেজে এসব ইসলাম বিনষ্টকারী ব্যক্তিরা পাসপোর্টের এই কারসাজির মাধ্যমে অতি সহজেই প্রতিটি মুসলিম দেশে ঢুকে পড়তে পারে।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান নামে মুসলমানদের জন্য নূতন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবার প্রাক্কালে কাদিয়ানীরা দুঃচিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমত পাকিস্তান সৃষ্টিতে কোন ভূমিকা না রাখা, দ্বিতীয়ত নতুন মুসলিম দেশে তাদের কি পরিচিতি হবে এটাই ছিল দুঃচিন্তার কারণ। তাদের জন্য কঠিন এই বিপদের দিনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আবারো হাজির হন ব্রিটিশ সরকার। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দর কষাকষিতে, পাকিস্তান নামক নতুন মুসলিম দেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চালানোর জন্য কিছু নামধারী মুসলিম ব্যক্তিকে বাছাই করে নিয়েছিলেন, যারা নামে মুসলিম জাতে কাদিয়ানী ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন স্যার জাফর উল্লাহ খান (১৮৯৩-১৯৮৫)। তিনি ব্রিটিশ আমলে ভারতের প্রথম রেল মন্ত্রী ছিলেন। পাকিস্তান স্বাধীন হবার প্রাক্কালে ১৯৪৭-১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের ১ম পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকার কাদিয়ানীদের রক্ষা করতে কায়দা করে জাফর উল্লাহ খানকে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে যান। উল্লেখ্য ব্রিটিশ রাজত্বে প্রকৃত সুন্নি মুসলমানেরা কখনও চাকুরী পেত না, এসব পদ মুসলমানদের দেবার কথা বলে, কাদিয়ানীদের বসিয়ে দেওয়া হত। তারা প্রচার করত দেখ কত বড় বড় পদ মুসলমানদের দেওয়া হয়েছে। এসব বড় কর্মকর্তাদের মুসলমান মনে করে সাধারণ মুসলিম জন সাধারণ খুবই উৎসাহ বোধ করত। ফলে ব্রিটিশ আমলেই বহু কাদিয়ানী সরকারী বড় কর্মকর্তা হবার সুযোগ পেয়ে যায়।
নতুন সৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্য যখন পাসপোর্ট বানাবার দরকার পড়ে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফর উল্লাহ খান পাসপোর্ট গুলোকে এমনভাবে তৈরি করেন যাতে কাদিয়ানীদের পরিচয় মুসলিম হিসেবে থাকে। কাউকে যাতে কাদিয়ানী হিসেবে সনাক্ত করতে না পারা যায়, সে জন্য পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করতে যে সব তথ্য লাগে সেখান থেকেও তাদের বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। কাদিয়ানীরা এই পলিসি নিরাপত্তার ভীতির জন্য করেনি! মুসলিম পরিচয়ে তারা যেন ইসলামী দেশ গুলোতে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে পারে, সেই ধান্ধায় এটি করেছে। গোলাম আহমেদ কাদিয়ানী তার নিজের ধর্মের জন্য যতটুকু করতে পেরেছে, পাকিস্তানী কাদিয়ানীদের রক্ষা করতে তার চেয়ে অনেক বেশী সার্ভিস দিয়েছে স্যার জাফর উল্লা খান। সদ্য গঠিত নূতন রাষ্ট্র পাকিস্তান কে পরিচালনা করার জন্য যোগ্য মানুষের দরকার হয়ে পড়ে, নূতন নতুন পদের জন্য নতুন ধরনের কর্মকর্তার অভাব দেখা দেয়। সে সব শূন্য পদে দলে দলে কাদিয়ানী ঢুকানোর জন্য জাফর উল্লা ও তার অন্যান্য সহকারী যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে কর্মকর্তা ছিল তারা বিরাট ভূমিকা রাখে। কাদিয়ানীদের মধ্যে যার যে ধরণের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল সেই ব্যক্তি তার মত করে প্রশাসনে ঢুকে যেতে পেরেছে। পুরো দেশের সকল শিক্ষিত কাদিয়ানীদের শহরে হাজির করা হয় এবং তাদের ধরে ধরে সরকারী চাকুরীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু মুসলমানের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্ট দুটি দেশের মধ্যে ভারতে হিন্দুরা আর পাকিস্তানে দৃশ্যত কাদিয়ানীরা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল..
ora kafer
ReplyDeleteসুন্দর
ReplyDeleteJazakallahu Khairan brother
ReplyDeleteমাশাল্লাহ
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
ReplyDelete