কুরবানীর গুরুত্ব ও ফযীলত
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,
(তরজমা)
“আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন।” (সূরা কাউছার-২)
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছেঃ “যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করল
না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের
নিকটেও না আসে।” (ইবনে মাজাহ হাঃ নং ৩১২৩)
কুরবানীর ফযীলত বর্ণনা প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, নবীজী (সাল্লাল্লাহু `আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ কুরবানীকৃত পশুকে তার শিং, পশম, খুর, ইত্যাদিসহ কিয়ামতের
ময়দানে হাজির করা হবে এবং নেকীর পাল্লায় তা ওজন করা হবে। আর কুরবানীর পশু যবেহ করার সাথে সাথে তার রক্ত
মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহ পাকের দরবারে তা কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্ট চিত্তে কুরবানী কর।” (তিরমিযী শরীফ
হাঃ নং ১৪৯৭)
কুরবানীর হুকুম
জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ সূর্যোদয় হতে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব
পর্যন্ত যদি কোন সুস্থ মস্তিষ্ক,প্রাপ্ত বয়স্ক মুকীম
ব্যক্তি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, অর্থাৎ ঋণমুক্ত
থাকা অবস্থায় সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন(৫২.৫০)তোলা রূপা অথবা সাড়ে
বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য সমপরিমাণ নগদ টাকা বা ব্যবসায়ের মাল কিংবা সমমূল্যের
নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কোন সম্পদ থাকে তাহলে তার উপর নিজের পক্ষ থেকে কুরবানী
করা ওয়জিব। কিন্তু পুত্র, কন্যা ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে তার কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। বরং তারা নিসাবের মালিক হলে নিজেরাই নিজের
কুরবানী আদায় করবে। অথবা তাদের
অনুমতিক্রমে গৃহকর্তা তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী দিবে। (শামী-৬/৩১২, আল ফিক্হুল ইস্লামী-৪/২৭১১, ২৭০৮)
কারো পক্ষ হতে তার অনুমতি ব্যতীত ওয়াজিব কুরবানী করা হলে সে ওয়াজিব
আদায় হবে না। অবশ্য একই
পরিবারভূক্ত কোন সদস্য অন্য সদস্যের পক্ষ হতে তার জ্ঞাতসারে নিয়মিত কুরবানী করে
আসলে সে ক্ষেত্রে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে, তবে এক্ষেত্রে
উত্তম হল প্রকাশ্যে তার থেকেও অনুমতি নিয়ে নেয়া। (আদ্দুররুল মুখতার-৬/৩১৫)
কুরবানীর পশু
চান্দ্র মাস হিসাবে পূর্ণ এক বৎসর বয়সের ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ও পূর্ণ দুই বৎসর
বয়সের গরু, মহিষ এবং পূর্ণ পাঁচ
বৎসর বয়সের উট-এ ছয় প্রকারের জন্তু দ্বারা কুরবানী করা যায়। প্রথম তিনটি মাত্র এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে এবং
পরের তিনটি সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়। তবে শর্ত হল,সকলের নিয়ত
খাঁটি ভাবে সওয়াবের জন্য হতে হবে। সাত শরীকের কোন একজনের নিয়তও যদি শুধু গোশত খাওয়ার জন্য হয় তাহলে
কারো কুরবানীই আদায় হবে না। (শামী-৬/৩১৫)
তেমনিভাবে কোন শরীকের মাল হারাম হলে বা অনুমতি না নিয়ে কাউকে শরীক
করলে সেক্ষেত্রে সকলের কুরবানী বাতিল হয়ে যায়। (শামী-৬/৩২৬)
উল্লেখ্য যে, ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন
হৃষ্ট-পুষ্ট হয় যে, ছয় মাসের বয়সেরটিও দেখতে এক বৎসর বয়স্ক মনে হয় তবে এর দ্বারাও কুরবানী জায়িয
আছে। কিন্তু বকরী বা ছাগলের
জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য নয়। (আদদুররুল মুখতার-৬/৩২১)
অন্ধ, কানা ও ল্যাংড়া জন্তু বা
এমন রুগ্ন ও দুর্বল জন্তু কুরবানীর স্থান পর্যন্ত যার হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই, অনুরূপভাবে এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশী লেজ ও কান কাটা কিংবা লেজ ও কান
বিহীন পশুর কুরবানী সহীহ হবে না। এবং অধিকাংশ দাঁত পড়ে যাওয়া পশু দ্বারাও কুরবানী সহীহ হবে না। ( শামী:৬/৩২৩, আল বাহরুর রায়িক:৮/৩২৪)
যবাইয়ের মাসাইল
১. নিজের কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবাই করা মুস্তাহাব, নিজে সক্ষম না হলে অন্য লোক দ্বারা করানো যায়।কিন্তু সেক্ষেত্রেও নিজে উপস্থিত থাকা উত্তম। মহিলাগণও সম্পূর্ণ পর্দার আড়ালে থেকে অবলোকন করতে
পারলে করবেন।(ফাতাওয়ায়ে শামী:৬/৩২৮, আল বাহরুর রায়িক:৮/২৩৮)
২. কুরবানী নিয়ত শুধু মালিক কর্তৃক মনে মনে করাই
যথেষ্ট, মুখে কিছু বলার আবশ্যকতা
নেই। অনুরূপভাবে মালিক নিয়ত
করার পর যবাইকারী কর্তৃক নামের লিস্ট পড়ারও জরুরত নেই। তবে “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার” অবশ্যই বলতে হবে। (শামী:৬/২৯৭-৩০১, আল ফিকহুল ইসলামী ৪/২৭৩১)
৩. কুরবানীর দু‘আ সশব্দে পড়া জরুরী নয়, মনে মনে পড়াই যথেষ্ট। দু‘আ না পড়লেও কুরবানীর কোন অসুবিধা হবে না। (শামী:৬/২৯৭)
৪. হলক এবং কন্ঠের মধ্যখানে যবেহ করতে হবে। নতুবা জানোয়ারটি হালাল হবে না।( বাদায়িয়ুস সানায়ে:৫/৪১)
৫. গলার ৪টি রগ তথা: খাদ্যনালী, শ্বাসনালী, দুটি রক্তনালী হতে কমপক্ষে ৩টি রগ না কাটলে পশু হালাল হবে না।( বাদায়িয়ুস সানায়ে:৫/৪১)
৬. কুরবানীর পশুকে মাথা দক্ষিণ দিকে দিয়ে কিবলামুখী
করে শুইয়ে প্রথমে এ দু‘আটি পড়তে পারলে পড়বে:
اللَّهُمَّ إنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِي
لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنْ
الْمُشْرِكِينَ إنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ
الْعَالِمِينَ- لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنْ الْمُسْلِمِينَ .
অত:পর “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর ” বলে যবাই করবে। যবাই করার পর এ দু‘আটি পড়া ভাল :
اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنِّي كَمَا
تَقَبَّلْتَ مِنْ حَبِيْبِكَ مُحَمَّدٍ وَ خَلِيْلِكَ إبْرَاهِيْمَ عَلَيْهِمَا الصَّلَاةُ
وَالسَّلَامُ
(বাদায়িয়ুস সানায়ে:৫/৬০, জাওয়াহিরুল ফিক্হ:১/৪৫০)
কুরবানীর গোশত
১. কুরবানী শরীকানা হলে গোশত ওজন করে সমানভাগে বন্টন করা জরুরী। অনুমান করে বন্টন করা নাজায়িয। (আল বাহরুর রায়িক:৮/৩২৭)
২. মুস্তাহাব বা উত্তম হচ্ছে, কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজেরা রাখবে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দিবে এবং এক ভাগ গরীব
মিসকীনদের দান করবে। তবে এটা ওয়াজিব
নয়, বরং মুস্তাহাব। তাই যদি কেউ কুরবানীর সমস্ত গোশত প্রয়োজনে নিজেরা খায় তাতেও গুনাহগার
হবে না।
কুরবানীর চামড়া
১. কুরবানীর চামড়া বিক্রি না করে
পরিশোধন করে নিজে ব্যবহার করা যায়। কুরবানীর চামড়া কুরবানী দাতার জন্য বিক্রি না করা উত্তম। এতদসত্ত্বেও কেউ বিক্রি করলে বিক্রয় মূল্য সদকা
করে দেয়া ওয়াজিব। যাদেরকে যাকাত
দেয়া জায়িয তারাই এর উপযুক্ত পাত্র। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়িয নেই তাদেরকে কুরবানীর চামড়ার মূল্য দেওয়াও
জায়িয নেই। (হিদায়া:৪/৪৫০)
২. কুরবানীর চামড়ার ব্যাপারে উত্তম পন্থা হল: তা
গরীব আত্মীয়-স্বজন বা দীনী শিক্ষায় অধ্যয়নরত গরীব ও এতীম ছাত্রদেরকে সরাসরি দান করে দেয়া। তালিবে ইলমদের দান করলে একদিকে যেমন দান করার সওয়াব পাওয়া যায়, অপরদিকে ইলমে দীন চর্চার মহান কাজে সহযোগিতাও করা হয় এবং এতে সদকায়ে
জারিয়ারও সওয়াব পাওয়া যায়। কুরবানীর চামড়া কোন দীনী প্রতিষ্ঠানের গরীব ছাত্রদের দান করে
প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করানো উত্তম। কেননা এতে অধিক মূল্য অর্জিত হয়ে গরীবের বেশী উপকার হয় এবং দাতার
সওয়াবও বেশী হয়। (জাওয়াহিরুল ফিকহ:১/৪৫৬)
৩. কুরবানীর গোশত বা অন্য অংশের বিনিময়ে, অনুরূপভাবে চামড়া বা চামড়া বিক্রিত টাকা দ্বারা যবাই করানো বা গোশত
কাটানোর পারিশ্রমিক দেয়া জায়িয নেই। দিলে তার উপযুক্ত মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। (শামী:৬/৩২০, ফাতহুল কাদীর ৮/৪৩৭)
যদি কোন কারণে কুরবানীর দিনগুলোতে কুরবানী করা সম্ভব না হয় তাহলে কুরবানীর পশুর
মূল্য গরীবদের মাঝে সদকা করে দেওয়া জরুরী। (শামী-৬/৩২০)
৪. কুরবানীর গোশত, চামড়া বা চামড়ার
মূল্য ইমাম, মুআযযিন, মাদরাসার শিক্ষক বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসাবে দেয়া যাবে না। তেমনিভাবে মসজিদ মাদরাসার নির্মাণ কাজেও লাগানো
যাবে না। (শামী: ৬/৩২৮, ফাতহুল কাদীর:৮/৪৩৭)
তাকবীরে তাশরীক
যিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখ ফজর হতে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয
নামাযের পর সকল সাবালক পুরুষ,মহিলার জিম্মায় উক্ত
তাকবীর একবার বলা ওয়াজিব। তিনবার বলা
ওয়াজিব নয়। পুরুষগণ
উচ্চস্বরে আর মহিলাগণ নিম্নস্বরে পড়বে। তাকবীরে তাশরীক এই :
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ
لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَاَللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ
الْحَمْدُ
(আদ্দুররুল মুখতার:২/১৭৭-১৮০)
ঈদের নামায সম্পর্কিত জরুরী দুটি
মাসআলা
১. যদি কেউ ঈদের নামাযের প্রথম রাকা‘আতে
রুকুর পূর্ব মুহূর্তে ইমামের সাথে শরীক হয় তাহলে যদি তার ধারনানুযায়ী তাকবীরে
তাহরীমা পড়ার পর অতিরিক্ত তিন তাকবীর বললেও রুকূ পাওয়ার আশা থাকে তাহলে
নিয়মানুযায়ী অতিরিক্ত তিন তাকবীর বলে রুকূ করবে। আর যদি অতিরিক্ত তাকবীর তিনটি বললে রুকূ পাবে না
বলে ধারনা হয় তাহলে রুকূতে গিয়ে অতিরিক্ত তিন তাকবীর বলবে। যদি প্রথম রাকা‘আতই না পায় তাহলে ইমাম
সাহেবের সালাম ফিরানোর পর ছুটে যাওয়া নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে সানা পড়ার পর অতিরিক্ত ৩
তাকবীর বলবে। ( আদ্দুররুল
মুখতার:১/১৫০, আল বাহরুর রায়িক:২/২৮২)
২. বর্তমানে ঈদের খুতবার শুরুতে ও মাঝে মাঝে খতীব
সাহেবগণ যে তাকবীরে তাশরীক বলে থাকেন; নির্ভরযোগ্য
কিতাবসমূহে তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এ ব্যাপারে সঠিক মাসআলা হল: প্রথম খুতবার শুরুতে ৯বার, দ্বিতীয় খুতবার শুরুতে ৭বার এবং দ্বিতীয় খুতবার শেষে মিম্বর থেকে নামার
পূর্বে ১৪বার শুধু “আল্লাহু আকবার” বলবে। এবং এটাই মুস্তাহাব। খুতবার সময় তাকবীরে তাশরীক বলবে না। হ্যাঁ! ঈদের নামায শেষে সালাম ফিরিয়ে তাকবীরে
তাশরীক একবার বলবে। ( মুসান্নাফে ইবনে
আবী শাইবা-৪/২৫২, মুসান্নাফে আব্দুর
রাজ্জাক-৩/২৯০, বাইহাকী সুনানুল কুবরা-৩/৪২০, ফাতাওয়ায়ে শামী:২/১৭৫, আহসানুল ফাতাওয়া:৪/১২৭)
- শাইখুল হাদীস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক (দা:বা:)জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া, মুহাম্মাদপুর-ঢাকা।
No comments:
Post a Comment