Tuesday, 18 November 2014

স্ত্রীদের জন্য উপদেশ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মহিলাদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেনঃ হে নারী সমাজ! তোমরা বেশী বেশী দান সদকা কর। কেননা, আমাকে দেখানো হয়েছে যে, দোযখীদের মধ্যে তোমাদের সংখ্যা অধিক। মহিলারা আরয করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! এর কারণ কি? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করলেন, অধিক পরিমাণে লা‘নত করে থাক আর স্বামীর না-শোকরী কর। তোমাদের জ্ঞান এবং দ্বীন অসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও একজন বিচক্ষণ মানুষের আকল তোমাদের চেয়ে অধিক বিলুপ্তকারী আর কাউকে আমি দেখিনি। মহিলারা আরয করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমাদের জ্ঞান ও দ্বীন অসম্পূর্ণ কিভাবে? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বললেন, তোমাদের স্বাক্ষ্যর মান পুরুষের অর্ধেক নয় কি? তারা বলল, নিশ্চয়। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা হল তোমাদের জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা। তারপরে ইরশাদ করলেন, একথা কি সত্য নয় যে, হায়েয অবস্থায় তোমরা নামায পড় না এবং রোযাও রাখ না? তারা বলল, নিশ্চয়। নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এটা হল তোমাদের দ্বীনের অসম্পূর্ণতা।
আলোচ্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নারী সমাজের পাঁচটি ত্রুটির কথা আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে দুটি হচ্ছে অনিচ্ছাধীন এবং তিনটি হচ্ছে ইচ্ছাধীন। অনিচ্ছাধীন দুটি হল জ্ঞানের স্বল্পতা এবং দ্বীনের অসম্পূর্ণতা। আর ইচ্ছাধীন তিনটি হল, স্বামীর না- শোকরী করা, অনর্থক লা‘নত ও অভিশাপ এবং বদ দু‘আ করা আর ভুল তথ্য দিয়ে বিচক্ষণ পুরুষের আকল বিলুপ্ত করে দেয়া। অনিচ্ছাধীন যে ত্রুটিগুলি রয়েছে সেগুলির বর্ণনা এজন্য করেছেন, যাতে মহিলাদের গর্ব ও অহংকারের রোগটি দূর হয়ে যায়। কেননা, গর্ব-অহংকার সাধারণতঃ জ্ঞানের স্বল্পতা থেকে সৃষ্টি হয়।
যাদের অন্তরে মহান রাব্বুল আলামীনের বড়ত্ব পয়দা হয়ে গেছে তারা নিজেকে অত্যন্ত ছোট মনে করে। যে ব্যক্তি রুস্তম পাহলোয়ানের শক্তি আর দানবীর হাতেম তাইয়ের দানের কথা স্মরণ করবে, সে কখনো নিজেকে শক্তিশালী আর দানশীল ভাবতে পারে না। যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ইলম আর প্রজ্ঞা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে, সে কখনো নিজকে বড় আলেম ভাবতে পারেব না। আজকাল তো অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, সামান্য বুযুর্গী অর্জন করতে পারলে নিজেকে অনেক কিছু ভেবে বসে। বিশেষ করে মহিলাদের তেলাওয়াতের পাবন্দ হলেই বা তাহাজ্জুদ পড়তে পারলেই নিজেকে রাবেয়া বসরী মনে করে বসে। আর অন্যকে ছোট মনে করে। এর কারণ এটাই যে, তাদেরকে কেউ তরবিয়াত করে না।
অবশিষ্ট তিনটি ইচ্ছাধীন ত্রুটি মহিলাদের ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। এগুলো ইচ্ছা ও চেষ্টা করলে সংশোধন করা সম্ভব। তার মধ্যে একটা হল, অধিক লা‘নত করা। অর্থাৎ কথায় কথায় কাউকে লা‘নত বা ভর্ৎসনা করা। তাদেরকে দেখা যায় সকাল থেকে সন্ধা যা পর্যন্ত এই কাজেই কেটে যায়। যার সাথে শত্রুতা আছে তার গীবত আর নিন্দাবাদ করতে করতে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। আর যার সাথে মহব্বত আছে তার প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। এমনকি নিজের সন্তানরাও যদি বিরক্ত করে বা সংসারের মাল সামানা নষ্ট করে তখন অনেক মহিলা মারাত্মক ধরনের অভিশাপ বা বদ দু‘আ দিয়ে বসে, যা কবুল হয়ে সেই বিপদ ঘটে গেলে আল্লাহর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে নিজের ঈমানই নষ্ট করে ফেলে।
নারীদের দ্বিতীয় দোষ হচ্ছে স্বামীর অকৃতজ্ঞতা। তাদেরকে যতকিছুই এনে দেয়া হোক, তা তাদের নিকট অল্প কম্‌দামী ও নিকৃষ্ট মনে হয়। মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব সাহেব দেহলবী (রহ) বলতেন, স্ত্রীদের যত দামী কাপড় থাকুক- যখন তুমি জিজ্ঞাসা করবে তোমাপ কাপড় চোপড় কিছু আছে? তখন উত্তরে বলবে- হাঁ, কয়েকটা বস্তা আছে। কোথাও পরে যাওয়ার মত না। আর জুতা যতই থাকুক, যদি জিজ্ঞাসা কর- তাহলে উত্তরে বলবে, হাঁ কয়েক জোড়া খড়ম আছে। এসব কথা স্বামীর মারাত্বক নাশোকরী। এ ধরনের কথা থেকে বেঁচে থাকা জরুরী।
মোট কথা লেবাস-পোশাক, অলংকারাদী, তৈজসপত্র, বাড়ী-ঘর সবকিছুতেই তারা অপচয় করে থাকে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অপচয় থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন। অনুরূপভাবে বিবাহ-শাদী, প্রথা-প্রচলন আর এমন কিছু রুসুমও তারা পালন করে যা শিরক ও বিদআতের পর্যায়ে পড়ে। তাছাড়া অহংকার, বড়ত্ব প্রকাশ। আর লোক দেখানো স্বভাব ইত্যাদি কোনটা থেকেই তারা মুক্ত নয়। তাই এসব রুসুম রেওয়াজ থেকে তাওবা করে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর পবিত্রা স্ত্রীগণের অনুসরণ এবং পায়রবী করা প্রতিটি নারীর একান্ত কর্তব্য।
নারীদের তৃতীয় দোষ হচ্ছে বিচক্ষণ পুরুষের আকল বিলুপ্ত করে দেয়া। অনেক সময় দেখা যায়, মহিলারা এমন সব অতিরঞ্জিত কথাবার্তা বলে যে, একজন বিচক্ষণ ও জ্ঞানী পুরুষও বোকা বনে যায়। তাদের কথার মধ্যে এমন প্রভাব আর যাদুময়তা থাকে যে, এমনিতেই পুরুষরা তাদের বশ হয়ে যায়। তার কারণ অবশ্য এটা নয় যে, তারা পুরুষের তুলনায় অধিক জ্ঞানী। বরং চাতুর্যতা আর ছলনায় তারা পুরুষ থেকে অগ্রগামী। জ্ঞান-গরীমা এক জিনিষ আর ছল-চাতুরী আরেক জিনিষ। মোটকথা, এই ছল-চাতুরী আর চালাকীর কারণেই নারী একজন বিচক্ষণ মানুষের বিচক্ষণতা নষ্ট করে দেয়। অনেক মহিলা নির্জনে স্বামীর সাথে এমন কায়দা-কৌশলে কথা-বার্তা বলে যাতে স্বামী সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তার সর্বপ্রথম ও প্রধান চেষ্টা হয় স্বামীকে তার পিতা-মাতা থেকে বিচ্ছন্ন করা। যে মা এত কষ্ট করে, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে কলিজাসম সন্তানকে প্রতিপালন করলেন-আজ তাদের প্রাপ্য হল সন্তান পৃথক হয়ে যাওয়া। এটা কত বড় জুলুমের কথা!! (আল্লাহ পাক আমাদেরকে এই অপকর্ম থেকে হেফাজত করুন) এখানেই শেষ নয় বরং স্বামীর উপার্জিত অর্থ যেন পিতা-মাতার নিকট না যায় সে জন্যও তার চেষ্টার কোন শেষ থাকেনা। স্বামীর ভাই-বোন কিংবা পুর্বের ঘরের সন্তান থাকলে তাদের থেকেও স্বামীকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। মোটকথা, তার দিন-রাতের ফিকির একটাই থাকে যে, আমি ছাড়া আর কারো সাথে যেন আমার স্বামী সম্পর্ক না থাকে। এর ফলে সমাজের বহু ফ্যামিলিতে, বহু অনৈক্য-বিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে। সমাজে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে।
পিতামাতার দায়িত্ব হচ্ছে, ছেলেদের বিবাহ দেয়ার পরে কিছুদিন নিজেদের সাথে রেখে তাকে গড়ে তোলার জন্য এবং সাংসারিক জীবনে পারদর্শী করে তোলার জন্য তাকে পৃথক কয়ে দেয়া। যৌথ সংসারের বেপর্দেগী থেকে বাঁচানোর জন্য, ভাইদের আপোষ মিল-মহব্বত বজায় রাখার জন্য এবং এধরনের আরো বহুবিধ উপকারের জন্য ছেলেকে পৃথক করে দিয়ে পিছন থেকে তাকে গাইড করা। এটাই শরীয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয়। অপর দিকে পৃথক হয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য কর্তব্য হচ্ছে, পিতা-মাতার খবর রাখা, তাদের খিদমত করা এবং সময়ে সময়ে হাদিয়া তোহফা পেশ করা। পিতা-মাতা নিজ দায়িত্বে এগুলি করবেন। স্ত্রী জন্য স্বামীকে ভুল তথ্য দিয়ে এগুলি করানো মারাত্মক অপরাধ।
নারী জাতির উল্লেখিত তিনটি দোষই এমন, যা সকল অন্যায়-অপকর্মের ভিত্তি। যেমন, অকৃতজ্ঞতা এবং স্বামীকে বেকুফ বানানোর মূলে রয়েছে লোভ-লালসা। অধিক লা‘নত থেকে সৃষ্টি হয় অনৈক্য, ঝগড়া-বিবাদ, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি। সুতরাং এই তিনটি মন্দ স্বভাবের সংশোধন করা একান্ত জরুরী। আর সংশোধনের পথ হল ইলম ও আমলের সমন্বয়। ইলমের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, গীবত ইত্যাদির বর্ণনা থাকবে। কেননা, নামায-রোযা শিক্ষার পাশাপাশি আখলাক-চরিত্র সংশোধন করাও জরুরী। আখলাক-চরিত্র সংশোধন না করলে ইবাদত-বন্দেগী কোন কাজে আসবে না।
একটি হাদীসে বর্ণিত আছে : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট আরয করা হল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! অমুক মহিলা খুব ইবাদত করে, রাত্রি জাগরণ করে। কিন্তু সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। ( তার কি হুকুম?) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে জাহান্নামী। অতঃপর অন্য এক মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সে ইবাদত বন্দেগী খুব বেশী একটা করতে পারে না কিন্তু প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, সে জান্নাতী।
সুতরাং ইলম হাসিল করার জন্য হযরত থানবী (রহ) রচিত বেহেশতী জেওর পুরাটাই পড়ে নেবে। তবে তোতা পাখির মত পড়ে গেলে কোন কাজ হবে না। বরং স্বামী যদি আলেম হয় তাহলে এক এক সবক করে তার নিকট পড়ে নিবে। আর স্বামী যদি আলেম না হয় তাহলে তাকে অনুরোধ করবে সে যেন কোন আলেমের নিকট থেকে বুঝে এসে এক সবক করে পড়িয়ে দেয়। আবার একবার পড়ে বন্ধ করে রেখে দিলেও চলবে না। বরং একটা সময় নির্ধারণ করে সর্বদা একা একা পড়তে হবে এবং অন্যকেও শোনাতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, যদি কেউ এ পদ্ধতি গ্রহণ করে তাহলে তার অবশ্যই সংশোধন হবে।

সংশোধনের আমলী পদ্ধতি হল, জরুরী কথা ব্যতিত মুখ বন্ধ রাখা। কেউ ভাল বলুক বা মন্দ বলুক কোন অবস্থাতেই কথা না বলা। এতে করে স্বামীর অকৃতজ্ঞতা, জ্ঞানীর জ্ঞান বিলুপ্ত করা, লা‘নত-অভিশাপ, গীবত-পরনিন্দা ইত্যাদি অধিকাংশ কু-অভ্যাস দূর হয়ে যাবে। কেননা, যখন প্রয়োজনীয় কথার বাইরে মুখ বন্ধ করে রাখা হবে তখন এ সকল রোগের আকাংখা দুর্বল আর নিস্ক্রীয় হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়তঃ একটা সময় নির্ধারণ করে নিয়ে তখন বসে বসে ভাববে যে, এই দুনিয়া আর কদিনের! একদিন তো এখান থেকে চলে যেতেই হবে। মৃত্যু এবং পরবর্তী বিষয় যথা, কবর, মুনকার-নকীরের প্রশ্ন, তার পরে কবর থেকে ওঠা এবং হিসাব-কিতাব, পুলসিরাত অতিক্রম করা ইত্যাদি বিষয়াবলী নিয়ে প্রতিদিন কিছু সময় গভীরভাবে চিন্তা করবে। এর ফলে দুনিয়া প্রীতি, ধন-সম্পদের মোহ, অহংকার, লোভ-লালসা ইত্যাদি আত্মার রোগ সমূহ দূর হয়ে যাবে। আর এজন্য আল্লাহ পাকের দরবারে দু‘আ জারী রাখাও উচিত।
  • শাইখুল হাদীস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক (দা:বা:)জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া, মুহাম্মাদপুর-ঢাকা।

No comments:

Post a Comment