Friday, 1 August 2014

গায়েবানা জানাযার শরয়ী বিধান

গায়েবানা জানাযা হলোদাফনের আগে বা পরে এমন মাইয়্যিতের জানাযার নামায আদায় করাযে মাইয়্যিত সামনে উপস্থিত নেই। সম্প্রতি এ জাতীয় জানাযার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচীর রূপ নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনেককে অংশগ্রহণ করতেও দেখা যায়। এ বিষয়ে শরয়ী সমাধান সবিস্তারে আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই শরীয়তের দলীলসমূহের আলোকে গায়েবানা জানাযার বিধান এখানে তুলে ধরা হলো-
মূল আলোচনার পূর্বে জানাযার গুরুত্ব ও রাসূল (সা.)এর জানাযার নামায আদায়ের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন
জানাযার নামাযের গুরুত্ব একটি স্বতঃসিদ্ধ বা সর্বজন স্বীকৃত বিষয়। জানাযার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন- প্রত্যেক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের পাঁচটি হক বা অধিকার রয়েছে। ১. সালামের উত্তর দেয়া। ২. অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা। ৩. জানাযা আদায় করা। ৪. দাওয়াত গ্রহণ করা। ৫. হাঁচির জবাব দেয়া (সহীহ বুখারী- ১/১৬৬ পৃষ্ঠা)
এছাড়া আরো অনেক হাদীস রয়েছেযা থেকে জানাযার গুরুত্বের বিষয়টি স্পষ্ট বুঝে আসেশুধু তাই নয়বরং রাসূল (সা.) নিজেও জানাযার নামায পড়ার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেনসাহাবাদের জানাযার প্রতি রাসূল (সা.) অধিক আগ্রহী হওয়ার বিষয়টি হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.)এর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়। যেমন- তিনি বলেন, “একদা রাসূল (সা.) একটি নতুন কবর দেখে বলে উঠলেনতোমরা কেন এই মাইয়্যিতের ব্যাপারে আমাকে অবহিত করনিলোকেরা বললআপনি  বিশ্রাম নিচ্ছিলেনতাই আপনাকে জাগ্রত করা সমীচীন মনে করিনি। এরপর নবীজী (সা.) দাঁড়ালেন এবং তার জানাযার নামায আদায় করলেন। নামাযে আমি তাঁর বাম দিকে দাঁড়ালে তিনি আমাকে ধরে তাঁর ডান পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন(আত-তাহক্বীক ফী আহাদীসিল খেলাফ লি ইবনিল জাওযী (রাহ.)- ২/১৬ পৃষ্ঠা)
এছাড়াও ইবনে উবাই মুনাফেক হওয়া সত্ত্বেও তার জানাযার নামায পড়ার প্রতি আগ্রহী হওয়া থেকেও রাসূল (সা.)এর অন্তরে জানাযার নামায ও মাইয়্যিতের জন্য দুআর গুরুত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে
দ্বিতীয় বিষয় হলোরাসূল (সা.)এর জানাযার সার্বণিক পদ্ধতি কী ছিলরাসূল (সা.)এর পুরো জীবনী তালাশ করলে দেখা যায় যেযতগুলো জানাযার নামায তিনি পড়িয়েছেন,সবগুলোতেই মাইয়্যিতকে সামনে রেখেই পড়িয়েছেন। (হ্যাঁবাদশা নাজাশীর জানাযা গায়েবানা ছিলো বলে যে দাবি করা হয়ে থাকেএ সম্পর্কে পরে আলোচনার প্রয়াস পাব,ইনশাআল্লাহ)। এমনকি মাইয়্যিতের কোন অংশ বরাবর রাসূল (সা.) দাঁড়াতেন এবং একাধিক মাইয়্যিত হলে কোন নিয়মে রাখা হতোতাও সাহাবায়ে কেরাম সযতেœ বর্ণনা করেছেন। আর রাসূল (সা.) ও তদীয় সাহাবাদের এ সকল পদ্ধতি থেকে সহজেই প্রমাণিত হয় যেমাইয়্যিতের উপস্থিতিতেই জানাযা পড়া সুন্নাত বা রাসূলের তরীকা
তাই তো রাসূল (সা.)এর যুগে অনেক সাহাবা দূর-দূরান্তে ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু জানাযার অত্যধিক গুরুত্ব এবং একান্ত হক হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (সা.) কোন সাহাবীর গায়েবানা জানাযা পড়েননি। ইমাম কামাল উদ্দীন ইবনুল হুমাম হানাফী (রাহ.) স্বীয় গ্রন্থ ফাতহুল কাদীরে বলেন, “সাহাবাদের অনেকে যাঁরা রাসূল (সা.) থেকে দূরবর্তী কোন সফরেযেমন হাবশা এবং বিভিন্ন জিহাদের ময়দানে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশেষ করে রাসূল (সা.)এর কুরআন শিক্ষাদানকারী প্রাণপ্রিয় সাহাবা যাঁরা (বীরে মাউনার সফরে) শাহাদাত বরণ করেছেন, (যাঁদের জন্য মাসব্যাপী কুনুতে নাযেলা পড়েছেন)তাঁদের জন্য নবীজীর গায়েবানা জানাযা পড়ার প্রমাণ নেই। অথচ তিনি স্বীয় সাহাবাদের জানাযা পড়ার প্রতি অতি আগ্রহী ছিলেন। এমনকি তিনি এ নির্দেশও দিয়েছিলেন যেতোমাদের কেউ যদি মৃত্যুবরণ করেতাহলে অবশ্যই আমাকে অবহিত করবে (যেন আমি তার জানাযা পড়িয়ে দিই)। কেননাআমার নামাযই হবে তার জন্য রহমত স্বরূপ (ফাত্হুল কাদীর- ২/১২১মাকতাবায়ে যাকারিয়াগুনয়াতুল মুতামাল্লী- ৫৮৪লাহোর)
রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পরলোক গমনের সময় তাঁর নিবেদিতপ্রাণ অনেক সাহাবাযাঁরা মদীনায় উপস্থিত হয়ে জানাযায় শরীক হতে পারেননি। তাদের কোন একজনও দূর দেশ থেকে নবীজীর গায়েবানা জানাযা পড়েননি। যদি বিষয়টি শরীয়ত সম্মত হতোতাহলে একজন সাহাবীও প্রাণাধিক প্রিয় এই মহামানব ও মহান রাসূলের জানাযা থেকে বঞ্চিত থাকতেন না। যেমনটিমানহুল জালীল প্রণেতা আল্লামা ইল্লীশ মুখতাসারিল খলীল-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেনতিনি বলেন, “মদীনায় নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়ার বিষয়টি রাসূলের বৈশিষ্ট্য ছিলকেননাউম্মত রাসূলের জানাযা আদায় করার প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেননি (শরহু মুখতাসারিল খলীল- ১/৩১৭ পৃষ্ঠা)
শুধু তাই নয় বরং অনুসরণীয় সোনালী তিন যুগ, বিশেষভাবে খেলাফতে রাশেদার সময়কালে কোন সাহাবী ও তাবেয়ীকে গায়েবানা জানাযা পড়তে দেখা যায়নি। অথচ মাইয়্যিতকে সামনে রেখে জানাযা পড়ার নজির অসংখ্য-অগণিত। সুতরাং মৃতের উপস্থিতিতে জানাযার নামায পড়া শরীয়তের বিধান। আর এ অবস্থার ভিত্তিতেই ইমামগণ জানাযা সহীহ হওয়ার জন্য মাইয়্যিত সামনে উপস্থিত থাকার শর্তারোপ করে থাকেন
উপরোক্ত আলোচনার মূল কথা হলোসমস্ত ইমামগণ উপস্থিত মাইয়্যিতের জানাযা ফরযে কিফায়া হওয়ার ব্যাপারে যেমন ঐক্যমত তেমনিভাবে অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা ফরয না হওয়ার ব্যাপারেও সবাই একমত। অর্থাৎ গায়েবানা জানাযা পড়াটা কোন ইমামই ফরয বা ওয়াজিব বলেন না। তবে হ্যাঁযদি কেউ গায়েবানা জানাযা পড়তে চায়তাহলে তা জায়েয হবে কিনাএ বিষয় নিয়ে ইমামগণের মাঝে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। যার সারসংপে নিম্নে আলোচনা করা হলো
গায়েবানা জানাযার ব্যাপারে ইমামদের মতামতঃ
ইমাম আযম আবু হানীফা (রাহ.) ও তার অনুগামী সকল ইমাম এবং ইমাম মালেক (রাহ.)এর মতে- গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। চাই দাফনের আগে হোক বা পরে। মাইয়্যিত শহরের ভিতরে থাক বা বাইরে
আল্লামা শামসুদ্দীন আস্ সারাখসী আল-হানাফী (রাহ.) বলেন, “আমাদের ওলামায়ে কেরাম বলেনঅনুপস্থিত মাইয়্যিতের জানাযা পড়া যাবে না (মাবসূতে সারাখসী- ২/৬৭দারুল কুতুবিল ইলমিয়াবৈরুত)
মুখতাসারুল খলীল-এর ব্যাখ্যা গ্রন্থে আল্লামা ইলিয়াস মালেকী (রাহ.) বলেন, “অনুপস্থিত মাইয়্যিতের জানাযা পড়া যাবে না (মানহুল জালীল- ১/৩৭৬ পৃষ্ঠা)
উল্লিখিত রেওয়ায়েত সমূহের আলোকে এবং ফক্বীহগণের মতামতের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট যে,হানাফী ও মালেকী মাযহাবে গায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। এ ব্যাপারে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহ.) থেকে জায়েয হওয়ার একটি উক্তি থাকলেও স্বীয় শাগরিদ ইবনে আবী মুসা তাঁর থেকে নাজায়েয হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। হাম্বলী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফিক্বাহ্বিদ আল্লামা ইবনে কুদামা (রাহ.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেনঅর্থাৎ- ইমাম মালেক (রাহ.) ও ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) উভয়ে বলেনগায়েবানা জানাযা জায়েয নেই। ইমাম আহমদ (রাহ.) থেকে ইবনে আবী মুসা উক্ত ইমামদ্বয়ের অনুরূপ (নাজায়েয হওয়ার) একটি উক্তি বর্ণনা করেছেন(আলমুগনীইবনে কুদামা (রাহ.)- ২/৩৮৬ পৃষ্ঠা)
আর আমরা পূর্বে প্রমাণাদিসহ আলোচনা করেছি যেএ মতটিই সুন্নাহ সম্মত
ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) ও ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রাহ.)এর মতে মাইয়্যিত ভিন্ন শহরে থাকলে গায়েবানা জানাযা জায়েয
যেমনটি বলেছেন ড. ওয়াহবাতুয যুহাইলী (রাহ.) গায়েবানা জানাযার ব্যাপারে ফিক্বাহ্বিদদের দুধরনের মতামত পাওয়া যায়। হানাফী ও মালেকী ফক্বীহগণ নাজায়েয হওয়ার অভিমত পোষণ করেনআর শাফেয়ী ও হাম্বলী ফক্বীহগণ তা জায়েয বলে উল্লেখ করেন (আল-ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু- ১/৫০৪মাকতাবাতুল হক্কানিয়্যাহপাকিস্তান)
এছাড়া ইমাম শাফেয়ী (রাহ.) শহরের বাইরে অবস্থিত মাইয়্যিতের ক্ষেত্রে তা জায়েয বললেও শহরের ভিতরে উপস্থিত মাইয়্যিতের ক্ষেত্রে তা নাজায়েয বলেছেন। যেমন ইমাম নববী (রাহ.) বলেন, “অবশ্য মাইয়্যিত যদি শহরের বাইরে থাকেতাহলে দুটি পদ্ধতি রয়েছে। তবে মাযহাবের বর্ণনা যেটাকে স্বয়ং মুছান্নিফ (রাহ.) এবং জমহুর ফুক্বাহায়ে কেরাম (সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিক্বাহবিদগণ) সমর্থন করেছেনতা হলো- মাইয়্যিতকে মুসল্লীর সামনে উপস্থিত করা ছাড়া অদৃশ্য জানাযা জায়েয নেই (আল মাজমু- ৫/২৫৩)
মোটকথাহানাফী ও মালেকী মাযহাবে গায়েবানা জানাযা নাজায়েয। পান্তরে শাফেয়ী মাযহাবে ভিন্ন শহরে অবস্থিত মাইয়িতের ক্ষেত্রে জায়েয থাকলেও নিজ শহরে উপস্থিত মাইয়্যিতের ক্ষেত্রে নাজায়েয। আর হাম্বলী মাযহাবেও ভিন্ন শহরে অবস্থিত মাইয়্যিতের ক্ষেত্রে জায়েয ও নাজায়েয উভয় প্রকার উক্তি পাওয়া যায়। আল্লামা ইবনু আবদিল বার (রাহ.) নাজায়েয হওয়ার উক্তিকে জমহুর ফুক্বাহা তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ ওলামায়ে কেরামের মতামত বলে অভিহিত করেছেন। যেমনটি উল্লেখ করেছেন বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া (রাহ.)। তিনি বলেন, “হানাফী ও মালেকী ওলামাগণ বলেনগায়েবানা জানাযা শরীআত সম্মত নয়। ইবনু আবদিল বার (রাহ.) এ উক্তিকে অধিকাংশ ওলামাদের মত হিসেবে উল্লেখ করেছেন (লামিউদ দারারী- ৪/৪৩২ পৃষ্ঠা)
গায়েবানা জানাযা জায়েয প্রবক্তাদের দলীল ও তার খন্ডনঃ
বুখারী শরীফে হযরত আবু হুরাইরা (রাযি.) সূত্রে একটি বর্ণনায় রয়েছে, “মহানবী (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে বাদশাহ নাজাশীর মৃত্যু সংবাদ দিলেন। অতঃপর জানাযার জন্য অগ্রসর হলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পিছনে কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়ালে নবীজী (সা.) চারটি তাকবীর বললেন (বুখারী শরীফদিল্লী- ১/ ১৬৭ পৃষ্ঠা)
একই বর্ণনা সহীহ ইবনে হিব্বানে (১/১৬৭) হযরত ইমরান ইবনে হাছীন (রাযি.) সূত্রে বর্ণিত হয়েছে 
হাদীসটির বিশ্লেষণঃ
প্রথমতঃ আলোচিত হাদীসটি এ ব্যাপারে দলীল হতে পারে নাকারণ বুখারী শরীফসহ কুতুবে সিত্তায় উক্ত হাদীসের যতগুলি বর্ণনা এসেছেসবগুলি সংপ্তি। সেগুলির কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ নেই যেজানাযার সময় নাজাশীর লাশ কোথায় ছিলোএ বিষয়ে পরিষ্কার কোন নস বা কুরআন-হাদীসে উল্লেখ নেই। তবে অপরাপর হাদীস গ্রন্থসমূহ অনুসন্ধানে নাজাশীর জানাযার বিস্তারিত বিবরণ সম্বন্ধীয় নির্ভরযোগ্য কয়েকটি বর্ণনা পওয়া যায়। যেগুলির প্রত্যেকটিতে উল্লেখ আছে যেবাদশাহ নাজাশীর লাশ মুজেযা স্বরূপ সামনে উপস্থিত করে দেয়া হয়েছিলফলে তা আর গায়েবানাই থাকে না। যেমনটি সহীহ ইবনে হিব্বানে আওযায়ী (রাহ.) সূত্রে হরযত ইমরান ইবনে হাছীন (রাযি.) থেকে বর্ণিত হয়। তাতে বলা হয়েছে যে, “সাহাবায়ে কেরামের প্রবল বিশ্বাস এটাই ছিল যেজানাযা হুযূর (সা.)এর সামনে উপস্থিত (সহীহ ইবনে হিব্বান- ৮৭২ পৃষ্ঠাহাদীস নং-৩১০২)
এছাড়া উক্ত বর্ণনাটি হযরত আবান (রাহ.) সূত্রে হযরত ইমরান ইবনে হাছীন থেকে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, “যখন নবীজী (সা.)এর পিছনে জানাযা পড়েছিতখন নাজাশীর লাশকে আমাদের সামনে উপস্থিত দেখতে পেয়েছি (উমদাতুল কারী শরহুল বুখারী- ৭/৩৩,মাকতাবায়ে তাওফীকিয়ামিসরফাতহুল বারী- ৩/২৪৩ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
সুতরাং উক্ত জানাযা যেহেতু গায়েবানাই ছিল নাতাই নাজাশীর হাদীসটি গায়েবানা জানাযা বৈধতার ব্যাপারে দলীল হতে পারে না 
দ্বিতীয়তঃ সাময়িকের জন্য যদিও মেনে নেয়া হয়নাজাশীর জানাযা গায়েবানা ছিলতবুও আমাদের জন্য তা জায়েয হবে না। কারণ তা একমাত্র রাসূল (সা.)এর সাথেই খাছ বা বিশেষিত ছিল। যার অন্যতম দুটি কারণ হলো- নবীজীর উক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ করে তার জীবদ্দশায় বা পরবর্তীতে কোন সাহাবী গায়েবানা জানাযা পড়েননি। এবং রাসূল (সা.)ও অন্য কোন সাহাবীর গায়েবানা নামায পড়ানোর ঘটনা গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়নি। যেমন এর সপে ইবনুল হুমাম (রাহ.)এর বক্তব্য উল্লেখ করে এসেছি। এছাড়াও মালেকী মাযহাবের ইমাম মুহাম্মাদ ইল্লিশ (রাহ.) উল্লেখ করেছেনঅর্থাৎ- মদীনায় নাজাশীর গায়েবানা জানাযা পড়ার বিষয়টি রাসূলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। কেননাউম্মত রাসূলের জানাযা আদায় করার প্রতি অধিক আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর গায়েবানা জানাযা আদায় করেনি। এবং নাজাশীর লাশকে অলৌকিকভাবে রাসূলের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে রাসূল (সা.) নাজাশীর লাশ সামনে দেখেই তার জানাযা পড়েছেন। যেমনমাইয়্যিত ইমামের সামনে থাকা অবস্থায় ইমাম মাইয়িতকে দেখতে পায়কিন্তু অনেক মুক্তাদী দেখতে পায় না। আর এ ক্ষেত্রে নামায সহীহ হওয়ার ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই (মানহুল জালীল- ১/৩১৬-৩১৭)
তৃতীয়ত: বুখারী শরীফের উক্ত হাদীসের শিরোনাম আল-জানাযাতু আলাস সুফূফ থেকেও গায়েবানা জানাযা নাজায়েযের দিকে ইমাম বুখারী (রাহ.)এর সমর্থন বুঝা যায়। শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া (রাহ.) বলেন, “আমার নিকট সঠিক এটাই মনে হয় যেইমাম বুখারী (রাহ.) এ মাসআলাটিতে হানাফী ও মালেকী মতকে সমর্থন করেছেন এবং আল-জানাযাতু আলাস সুফূফ তথা জানাযাতে কাতারবন্দী হওয়া শিরোনাম স্থাপন করে ইঙ্গিত করেছেন যেনাজাশীর জানাযা দৃশ্যমান ছিলগায়েব ছিল না। আর এটাই উক্ত মাযহাবদ্বয়ের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা (যা আলোচ্য বিষয়কে সমর্থন করে)। তাইতো হাদীস থাকা সত্ত্বেও তিনি আল-গায়েবু আলাস সফূফ তথা অনুপস্থিত ব্যক্তির জানাযা অধ্যায় স্থাপন করেননি। তাছাড়া বুখারী শরীফে শিরোনাম স্থাপনের নীতিমালার ৬৫ নম্বরে  উল্লেখ রয়েছেকোন মাসআলা ইমাম বুখারী (রাহ.)এর মতামতের পরিপন্থী হলে শিরোনাম হিসেবে উল্লেখ করেন না। (হাশীয়া লামিউদ দারারী শরহুল বুখারী- ২/১২২মাকতাবাতুল আশরাফিয়া দিল্লী)
উক্ত ব্যাখ্যা থেকে বুঝা গেলস্বয়ং ইমাম বুখারী (রাহ.) এ হাদীসকে গায়েবানা জানাযার বৈধতার ক্ষেত্রে দলীল মনে করতেন না
একটি সংশয় ও তার নিরসনঃ এখানে একটি সংশয় সৃষ্টি হতে পারে যেযদি গায়েবানা জানাযা জায়েযই না হতোতাহলে হারাম শরীফে কিভাবে বিশ্ববরেণ্য ইমামগণকে তা পড়তে দেখা যায়?
নিরসনঃ পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যেগায়েবানা জানাযা যেহেতু শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবে জায়েয আছে। আর সেখানকার ইমামসহ স্থানীয় মুসল্লীগণ এবং প্রশাসনও উক্ত মাযহাবদ্বয়ের কোন একটার অনুসারী। তাই তারা নিজেদের মাযহাব অনুসারে গায়েবানা জানাযা পড়ে থাকেন। এজন্য হানাফী মাযহাবের অনুসারীদের জন্য তা জায়েয হয়ে যাবে না। আর ইতিপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে যেগায়েবানা জানাযা না পড়াই ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সার্বণিক কর্মপন্থা
রাজনৈতিক সূত্রে গায়েবানা জানাযার হুকুমঃ বর্তমানে হানাফী মাযহাবের অনুসারী হয়েও অনেকজনকে গায়েবানা জানাযা পড়তে দেখা যায়। শুধু তাই নয়বরং রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর গায়েবানা জানাযাও পড়া হয়। শরীয়তে তা কখনোই জায়েয হবে না বরং ইবাদতকে রাজনীতি বানানো বা ইবাদত থেকে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাই হবে মাত্র। যাতে সাওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ ও আযাবের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন॥ (জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া- ২/৪২এদারাতুল কুরআন)
[ইসলামী আইন ও সাহিত্য গবেষণা পরিষদদারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী-এর মাসিক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত প্রবন্ধ]

No comments:

Post a Comment