Tuesday, 9 September 2014

সত্যসন্ধানী আহলে হাদীস ভাইদের ভেবে দেখার আহ্বান

সত্যসন্ধানী আহলে হাদীস ভাইদের ভেবে দেখার আহ্বান

১. আমাদের দেওবন্দী আকাবেরদের প্রতিরোধের মুখে কিছু দিন পূর্ব পর্যন্তও আহলে হাদীস নামক ফেতনার দরজা বন্ধ ছিল। কিন্তু আমাদের অলসতার সুযোগে তারা আবার নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেছে। এতদিন পর্যন্ত তারা গর্তের মধ্যে আত্মগোপন করে ছিল। এখন তারা গর্ত থেকে বের হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা বলে আমরা নাকি আবূ হানীফা রা. কে নবী মেনে কাফের হয়ে গেছি। আমরা কীভাবে আবূ হানীফাকে নবী মানলাম? আমরা তো হাজারো মাসআলায় আবূ হানীফা রাহ. এর তাকলীদই করি না। কারণ, সেগুলি স্পষ্ট। আবার হাজারো মাসআলায় হানাফী মুফতীগণ সাহেবাইনের (ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদ রহ.) মতানুযায়ী ফাতাওয়া দেন। তাহলে কীভাবে আমরা আবূ হানীফা রা.কে নবী মানলাম? আর সব বিষয়ে কি ইমামের তাকলীদ করা হয়? তাকলীদ তো করা হয় এমন কিছু জটিল বিষয়ে যার সমাধান কুরআন-হাদীসে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। এমনিভাবে একই বিষয়ে বাহ্যিকভাবে সাংঘর্ষিক একাধিক হুকুম পাওয়া যায়, এখন কোনটা নাসেখ আর কোনটা মানসূখ তাতো আমরা জানি না বা বুঝতে পারিনা। এই ধরণের ক্ষেত্রে খাইরুল কুরূনের মুজতাহিদ ইমামদের বুঝকে আমরা আমাদের বুঝের চেয়ে শতগুণ উত্তম মনে করে তাদের বুঝের অনুসরণ করি, তাদের ব্যক্তি সত্তার অনুসরণ করি না। এটাই তাকলীদের মূলকথা। কিন্তু যে-সব বিষয় কুরআন-সুন্নাহয় স্পষ্টভাবে আছে যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া, রমযানে রোযা রাখা, যাকাত দেওয়া, হজ করা, এ জাতীয় শতশত বিষয়ে আমরা কোনো ইমামেরই তাকলীদ করি না। কারণ এসব বিষয় কুরআন-সুন্নাহ থেকেই আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তাহলে আমরা কীভাবে ইমামদের তাকলীদ করে কাফের-মুশরিক হয়ে গেলাম ?!
 আহলে হাদীস নামক এই ভ্রান্ত মতবাদকে নতুন করে চাঙ্গা করে গেছেন মরহুম নাছিরুদ্দীন আলবানী। তার কোনো উস্তাদ ছিল না। কেউ তার কোনো উস্তাদ দেখাতে পারবে না। (নাছিরুদ্দীন আলবানীর বাড়ি  সিরিয়ার আলবানিয়া নামক স্থানে। তার পিতা নূহ নাজাতী হানাফী মাযহাবের শীর্ষ পর্যায়ের আলেম ছিলেন। ছেলের বিতর্কিত আচরণে অধৈর্য হয়ে তিনি ছেলেকে ত্যাজ্য ঘোষণা করেন। আর সিরিয়ার জনগণ শায়খ আলবানীকে বিতর্কিত মতবাদের কারণে সিরিয়া থেকে বের করে দেয়। তারপর তিনি সৌদি আরবে আশ্রয় নেন। একপর্যায়ে সৌদির আলেম উলামা এবং জনগণও তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। ফলে সরকারী নির্দেশে১৯৯১ সালে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি আরব ভূমি ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর জর্ডানে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই ১৯৯৯ সালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মাসিক আল আবরার,বসুন্ধরা, জানুয়ারী ২০১৩ঈ.) নিজে নিজে রিসার্চ করে যা বুঝেছেন তাই লিখেছেন। তার বিশেষ অবদান (?) এই যে, তিনি হাদীসের কিতাব থেকে সহীহ আর যয়ীফ কে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। পরে যয়ীফ এর সাথে মউযূকে মিলিয়ে দিয়েছেন। আর কিতাব লিখেছেন, سلسلة الاحاديث الضعيفة و الموضوعة واثرها السيئ فى الامةসিলসিলাতুল আহাদীসিয যয়ীফা ওয়াল মাউযূআহ ওয়া আসারুহাস সাইয়্যেউ ফিল উম্মাহ’  প্রশ্ন এই যে, যয়ীফ আর মাউযূকে কি একই হুকুম দেওয়া যায়? মাউযূ তো হাদীসই না। এটাতো রাসূলের নামে মিথ্যা কথা। অথচ যয়ীফ তো হাদীস। যু‘ফ মূলত সনদের সিফাত। হাদীসের সিফাত নয়। যেমনিভাবে সহীহ হাসান এগুলিও সনদের সিফাত। হাদীসের সিফাত নয়।  এর দ্বারা সনদের অবস্থা বুঝানো হয়। যয়ীফ হাদীস যদি একাধিক সনদে আসে তাহলে তা হাসান লি-গাইরিহি হয়ে যায়। তখন এর দ্বারা হুকুমও সাবেত হয়। এমনিভাবে যয়ীফ হাদীস যদি উম্মত কবূল করে নেয় তাহলে তা সহীহ এর মত হয়ে যায় যেমন: لاوصية لوارث এই হাদীস তো যয়ীফ কিন্তু উম্মত এই হাদীস ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে আসছে বলে এই হাদীস মা‘মূলবিহি হয়েছে। এর দ্বারা হুকুম সাবেত হয়েছে। এমনিভাবে طلب العلم فريضة على كل مسلم এই হাদীসটি ৫০টি সনদে এসেছে।(ইবনে মাজাহ ২২৪ নং হাদীস এর টিকা) প্রত্যেকটি সনদই যয়ীফ। কিন্তু এতগুলি সনদে আসায় হাদীসটি হাসান লি-গাইরিহি হয়ে গেছে, ফলে এর দ্বারা ফরযের মত গুরুত্বপূর্ণ হুকুম সাবেত করা হয়েছে। আর যয়ীফ হাদীস যদি হাসান লি-গাইরিহি পর্যন্ত নাও পৌঁছে তবুও তা বেকার নয়; বরং কিছু শর্ত সাপেক্ষে ফযীলাতের ক্ষেত্রে আমলযোগ্য। তাহলে এবার আপনারাই বলুন, কীভাবে যয়ীফ হাদীসকে মউযূ হাদীসের মতো মনে করা সঠিক হতে পারে? বর্তমানে আরব বিশ্বে আলবানীর বিরুদ্ধে অনেক কিতাব লেখা হচ্ছে। ‘তানাকুযাতে আলাবানী’ নামক কিতাবটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কিতাবে আলবানীর স্ববিরোধী কথা-কাজ তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো এক জায়গায় কোনো একটি হাদীস তার মতের পক্ষে হওয়ায় তিনি ঐ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন আবার ঐ একই সনদের হাদীস দ্বারা যখন তার বিরোধীরা দলীল দিয়েছেন তখন তিনি হাদীসটিকে যয়ীফ বলে দিয়েছেন। এ জাতীয় অনেক ঘটনা ঐ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (শায়খ আলবানীর বিরুদ্ধে লিখিত আরো কিছু কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলো: শয়খ আব্দুল্লাহ ইবনে সিদ্দীক আলগুমারী প্রণীত القول المقنع فى الرد على الالبانى المبتدع  ‘নতুন মতবাদের প্রবর্তক আলবানীর সন্তোষজনক প্রতিউত্তর’। শায়খ মাহমূদ সাঈদ মাহমূদ প্রণীত ছয় ভলিউমে প্রকাশিত বিশাল কিতাব التعريف باوهام من قسم السنن الى صحيح وضعيف ‘যে ব্যক্তি হাদীসকে সহীহ ও যয়ীফ দুই ভাগে ভাগ করেছে তার ভুল-ভ্রান্তির পরিচয়’। শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রহ. প্রণীত كلمات فى كشف اباطيل و افتراءات ‘আলবানীর বাতিল মতবাদ ও মিথ্যা অপবাদের উন্মোচনে কিছু কথা’। এছাড়াও আরো অনেক কিতাব রয়েছে যা এখানে উল্লেখকরা সম্ভব নয়।) যাইহোক বলা হচ্ছিল যে, আহলে হাদীস ফেরকাটা বৃটিশরা  তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থে তৈরি ও অনুমোদন করে গেছে।
 ২. ১২৪৬ হিজরীর আগে পৃথিবীতে আহলে হাদীস নামে কোনো ফেরকা ছিল না। ‘আহলুল হাদীস’ তো মুহাদ্দিসীন তথা হাদীস বিশারদ ইমামদের উপাধি। বর্তমান আহলে হাদীস ফেরকা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে এ কথার দাবি করছে যে, তারা সর্বক্ষেত্রে হাদীস মেনে চলে। অথচ হাদীসের কিতাবে কোথাও নবীজী সা. হাদীস মানতে বলেননি। নবীজী সা. যেখানেই নিজেকে মানতে ও অনুসরণ করতে বলেছেন সেখানেই সুন্নাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ নবীজী সা. উম্মাতকে সুন্নাহ অনুসরণ করতে বলেছেন, সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন, হাদীস অনুসরণ করতে বলেননি কিংবা আঁকড়ে ধরতে বলেননি; বরং নবীজী সা. গোমরাহ ফেরকার কার্যক্রম বুঝাতে গিয়ে হাদীস শব্দ ব্যবহার করেছেন। কারণ গোমরাহ ফেরকা মানুষকে হাদীস বলে বলে গোমরাহ করবে, সুন্নাহ বলে নয়। যেমন নবীজী সা. এক হাদীসে বলেন: ‘শেষ যমানায় অনেক প্রতারক ও মিথ্যুক লোকের আবির্ভাব হবে, তারা তোমাদের কাছে এমন হাদীস পেশ করবে যা তোমরাও শুননি, তোমাদের পূর্বপুরুষরাও শুনেনি। সাবধান! তারা যেন তোমাদেরকে গোমরাহ করতে না পারে।’ সহীহ মুসলিম হা.নং ৭
 আর জেনে রাখা উচিত যে, হাদীস ও সুন্নাহ এক নয়; বরং এ দু’য়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। আমাদের আকাবিরগণ, বিশেষকরে বর্তমান দারুল উলূম দেওবন্দ এর সদরুল মুদাররিসীন ও শাইখুল হাদীস মুফতী সাঈদ আহমাদ পালনপুরী দা.বা. তার বিভিন্ন কিতাবে হাদীস ও সুন্নাহ এর পার্থক্য বর্ণনা করেছেন। যার সারকথা এই, উম্মতের জন্য দ্বীনের উপর চলার অনুসরণীয় পথকে সুন্নাহ বলে। আর প্রত্যেক সুন্নাহই হাদীস কিন্তু অনেক হাদীস সুন্নাহ হলেও সকল হাদীস সুন্নাহ নয়। অর্থাৎ সকল হাদীস উম্মতের জন্য দ্বীনের উপর চলার অনুসরণীয় পথ নয়। কেননা হাদীসের মধ্যে এমন অনেক হাদীস আছে যা মানসূখ হয়ে গেছে যেমন: বুখারী শরীফের কিতাবুল জানায়েযের প্রায় এক পৃষ্ঠা ব্যাপী ১৩০৭-১৩১৩ নং হাদীসগুলি মনসূখ। যেখানে জানাযা নিয়ে যেতে দেখলে সকলকে দাঁড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। এই হুকুম অন্য সহীহ হাদীস দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। (উমদাতুল কারী ৬/১৪৬) এমনিভাবে প্রথম যুগে নামাযে কথা বলা, সালাম দেওয়া, সালামের উত্তর দেওয়া সবই জায়েয ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এই হুকুম রহিত হয়ে গেছে। (সহীহ বুখারী হা.নং১১৯৯,১২০০) এমনিভাবে ইসলামের প্রথম যুগে এই হুকুম ছিল যে, আগুনে পাকানো কোনো জিনিস খেলে উযূ ভেঙ্গে যাবে, কিন্তু পরবর্তীতে এই হুকুম রহিত হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা.নং ২০৮) এমনিভাবে নবীজী সা. হিজরতে পর মদীনায় ১৬/১৭ মাস বাইতুল মুকাদ্দাস এর দিকে ফিরে নামায আদায় করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই হুকুম রহিত হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী হা.নং৭২৫২) তো এগুলি সবই সহীহ হাদীস, কিন্তু সুন্নাহ নয়। অর্থাৎ এই হাদীসগুলি উম্মতের জন্য অনুসরণীয় নয়। আর এমন অনেক হাদীস আছে যার হুকুম নবীজী সা. এর সাথে খাস যেমন: নবীজী সা. এর ১১টি বিবাহের কথা এবং মহর দেওয়া ছাড়া বিবাহ করার কথা  হাদীসে এসেছে তো এগুলি হাদীস বটে, কিন্তু উম্মতের জন্য অনুসরণীয় নয়। (সুবুলুল হুদা ওয়াররশাদ ফী সীরাতে খাইরিল ইবাদ১১/১৪৩-২১৭) আর এমন অনেক হাদীস আছে যা নবীজী সা. কখনো কোনো বিশেষ প্রয়োজনে করেছেন যেমন: একবার কোমরে ব্যথা থাকায় বা বসলে কাপড়ে নাপাক লাগার আশংকায় তিনি দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন, তো এই হাদীসের জন্য কি আপনি দাঁড়িয়ে পেশাব করাকে সুন্নাত বলবেন? এমনিভাবে নবীজী সা. ইহরাম অবস্থায় এবং রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা.নং১৯৩৮) তাই বলে কি আপনি ইহরাম ও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগানোকে সুন্নাত বলবেন? তাছাড়া শুধু জায়েয এ কথা  বুঝানোর জন্য নবীজী সা. অনেক কাজ করেছেন যেমন: নবীজী সা. একবার তাঁর এক নাতনীকে (উমামাহ বিনতে যয়নাব) কোলে নিয়ে নামায পড়িয়েছেন। (সহীহ বুখারী হা.নং ৫১৬) এই ঘটনা তো হাদীসে এসেছে, তাই বলে কি আপনি বাচ্চা কোলে নিয়ে নামায পড়াকে সুন্নাত বলবেন? কক্ষনো না; বরং এই হাদীস দ্বারা নবীজী সা. একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে বাচ্চাকে কোলে নিয়েও নামায পড়া যেতে পারে। এমনিভাবে রোযা অবস্থায় নবীজী সা. তাঁর এক বিবিকে চুম্বন করেছেন। (সহীহ বুখারী হা.নং ১৯২৮) তাই বলে কি আপনি রোযা রেখে স্ত্রী চুম্বন করাকে সুন্নাত বলবেন?
 উক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা গেল যে, আহলে হাদীস নামটাই ঠিক না। কারণ নবীজী সা. উম্মতকে কোথাও হাদীস মানতে বলেননি; বরং সুন্নাহ মানতে বলেছেন। যারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বলে তাদের উচিত ১১টি বিবাহ করা, মহর ছাড়া বিবাহ করা, ইহরাম ও রোযা অবস্থায় শিঙ্গা লাগানো, রোযা অবস্থায় স্ত্রী চুম্বন এবং দাঁড়িয়ে পেশাব করা ইত্যাদিকে সুন্নাত মনে করা। তারাবীহ নামায শুধু তিনদিন মসজিদে এসে পড়া, কারণ নবীজী সা. শুধু তিন দিনই মসজিদে এসে তারাবীহ পড়েছেন। (সহীহ বুখারী হা.নং২০১২) এমনিভাবে নামাযে কথা বলা ও সালাম দেওয়ার কথাও যেহেতু হাদীসে এসেছে তাই তাদের উচিত, নামাযে কথা বলা ও সালাম দেওয়া। কিন্তু তারা তো এসব করে না। তাহলে কীভাবে তারা আহলে হাদীস হলো? বুঝা গেল, তাদের নামটাই সঠিক না এবং তারা নিজেদেরকে আহলে হাদীস বললেও বাস্তবে তার সব হাদীস মানে না। তাছাড়া নবীজী সা. উম্মতকে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। হাদীস আঁকড়ে ধরতে বলেননি। তাই আমরা নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ বলি অর্থাৎ আমরা নবীজী সা. এর সুন্নাত মানি এবং সাহাবায়ে কেরামের জামাআতকে অনুসরণ করি। নবীজী সা. উম্মতকে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন ও মানতে বলেছেন এসম্পর্কীয় কয়েকটি হাদীস নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. المتمسك بسنتى عند فساد امتى فله اجر شهيد.  المعجم الاوسط برقم:৫৪১৪
২. تركت فيكم امرين ...كتاب الله وسنة رسوله.   المؤطا لمالك برقم:৮৯৯
৩. من احيا سنة من سنتى قد اميتت بعدى فان له من الاجرمثل اجورمن عمل بها....  ترمذى برقم:২৬৭৭ 
৪. من احيا سنتى فقد احبنى.... ترمذى برقم:২৬৭৮
৫. من اكل طيبا وعمل فى سنة وامن الناس بوائقه دخل الجنة.  ترمذى برقم:২৫২০
৬. تمسك بسنة خير من احداث بدعة... مسند احمد৪/১০৫
৭. ما من نبي بعثه الله فى امته قبلى الا كان له فى امته حواريون واصحاب يأخذون بسنته...الصحيح لمسلم برقم:৮০
৮.عليكم بسنتى وسنة الخلفاء الراشدين المهديين تمسكوابها...ابوداؤد برقم:৪৬০৭
৯. ستة لعنتهم و لعنهم الله ... و التارك لسنتى. ترمذى برقم:২১৫৪
১০. فعليكم بماعرفتم من سنتى و سنة الخلفاء الراشدين... ابن ماجة برقم:৪৩
এই মুহূর্তে দশটি হাদীস উল্লেখ করা হলো যার সবকয়টির মধ্যে  নবীজী সা. উম্মতকে সুন্নাহ আঁকড়ে ধরতে বলেছেন, সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করতে বলেছেন এবং সুন্নাহ তরককারীর উপর লানত করেছেন। একটি হাদীসের মধ্যেও তিনি হাদীসকে আঁকড়ে ধরতে বলেননি। আহলে হাদীস ফেরকাকে সীমাহীন সময় দেওয়া হলো, তারা এমন একটি হাদীস পেশ করুক যেখানে নবীজী সা. উম্মতকে হাদীস আঁকড়ে ধরতে বলেছেন কিংবা হাদীস অনুযায়ী উম্মতকে চলতে বলেছেন। হ্যাঁ নবীজী সা. হাদীসকে রেওয়ায়েত করতে বলেছেন, অন্যের কাছে পৌঁছাতে বলেছেন, কিন্তু আঁকড়ে ধরতে বা আমল করতে বলেননি। আমল করার জন্য হাদীস অবশ্যই সুন্নাহ পর্যায়ে পৌঁছতে হবে।
নবীজী সা. যেহেতু হাদীস ও সুন্নাহর মধ্যে পার্থক্য করে গেছেন অর্থাৎ সুন্নাহ এর উপর আমল করতে বলেছেন আর হাদীসকে শুধু রেওয়ায়েত করতে বলেছেন, তাই এই পার্থক্য ঠিক রাখার জন্য হাদীসের সংকলকগণ তাদের কিতাবের নাম হাদীস শব্দ দ্বারা রাখেননি; বরং সুন্নাহ শব্দের বহুবচন সুনান দ্বারা রেখেছেন। যেমন: সুনানু আবী দাউদ, সুনানুন্ নাসাঈ, সুনানু ইবনে মাজাহ, সুনানুত্ তিরমিযী, সুনানুদ দারেমী, সুনানুদ্দারাকুতনী, সুনানুল বাইহাকী, সুনানু সাঈদ ইবনে মানসূর ইত্যাদি। এসব কিতাবের লেখকগণ নিজ নিজ কিতাবে ‘বাবুল ই‘তিসাম বিল কিতাবে ওয়াস্সুন্নাহ’ নামক শিরোনাম দিয়ে কুরাআন এবং সুন্নাহ আঁকড়ে ধরার ব্যাপারে নবীজী সা. এর বাণী উল্লেখকরেছেন। শিরোনাম লেখার ক্ষেত্রেও তারা হাদীস শব্দ ব্যবহার করেননি। এমনিভাবে আইম্মায়ে উসূল শরীয়তের দলীল চতুষ্টয় বর্ণনার সময় প্রথমে কিতাবুল্ল¬াহ এরপর সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ বলেছেন। এখানেও তারা হাদীস শব্দ ব্যবহার করেননি। অর্থাৎ হাদীসু রাসূলিল্লাহ বলেননি। কারণ তারা বুঝতেন যে, হাদীস সাধারণভাবে উম্মতের আমল করার জন্য নয়; বরং সুন্নাহ অনুযায়ী উম্মতকে চলতে হবে, আমল করতে হবে।
 ৩. আহলে হাদীস ফেরকা তাকলীদকে শিরক বলে। অথচ তারা তাদের দাবি প্রমাণে বুখারী, মুসলিম এই ধরণের যে-সব হাদীসের কিতাব দেখে দলীল দেয়, সে-সব কিতাবের কোথাও তাকলীদকে শিরক বলা হয়নি; বরং এই কিতাবগুলোর লেখক সবাই কোনো না কোনো মুজতাহিদ ইমামের তাকলীদ করতেন। যেমন: ইমাম বুখারীমুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ এই চার জন শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। (তাবাকাতুশ শাফেইয়্যাহ১/৪২৫-৪২৬) আর ইমাম আবূ দাঊদ, নাসাঈ এই দু‘জন হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।(মাআরেফুস সুনান)১/৮২-৮৩) এখন প্রশ্ন হলো তাকলীদ করার করণে কেউ যদি মুশরিক হয়ে যায় তাহলে তাদের কথা অনুযায়ী সিহাহ সিত্তার ছয়জন লেখকই মুশরিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের কিতাব দিয়ে দলীল দেয় কেন? মুশরিকদের লেখা কিতাব দিয়ে দলীল দেয়া জায়িয হবে কি ? (তাছাড়া মুজতাহিদ ব্যতীত আজ পর্যন্ত যে-সব বড় বড় উলামায়ে কেরাম পৃথিবীর বুকে আগমন করেছেন তারা সবাই কোনো না কোনো মাযহাবের অনুসারী ছিলেন । তাঁরা কুরআন-সুন্নাহ এর সুগভীর জ্ঞান রাখা সত্ত্বেও তাকলীদ করাকেই নিজের জন্য নিরাপদ মনে করেছেন। আজকাল কিছু কিছু লোককে দেখা যায়, তারা অনুবাদসহ দুই চারটা হাদীস মুখস্ত করে নিজেকে পূর্বযুগের আলেমদের চেয়ে বেশি জ্ঞানী ভাবতে শুরু করে দেয়। তারা কয়েকটি হাদীসের অনুবাদ পড়েই নিজেকে যুগের মুজতাহিদ ভাবতে শুরু করে। এমনটি করা কখনোই তাদের জন্য শোভনীয় নয়। যারা বিজ্ঞ আলেম কিংবা ফকীহ নয় তাদের কাজ তো শুধু এতটুকু যে,তারা কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে, উলামা এবং ফুকাহাদের কাছে জিজ্ঞেস করে সে অনুযায়ী আমল করবে। উস্তাদ ছাড়া নিজে নিজেই কুরআন বা হাদীস রিসার্চ করা সাধারণদের দায়িত্ব নয়। আল্লাহ তা’আলা সাধারণ মানুষকে এ দায়িত্ব দেননি। সাধারণদেরকে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন ‘তোমরা কোনো কিছু না জেনে থাকলে আহলুযযিকির তথা উলামা-ফুকাহাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নেও’ সূরা নাহল:৪৩,সংকলক)
 ৪. তাছাড়া তারা যে হাদীসের ক্ষেত্রে সহীহ, যয়ীফ, ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহার করে এসবও তো তারা তাকলীদ করনেওয়ালাদের কিতাব থেকেই নিয়েছে। উসূলে হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘নুখবাতুল ফিকার’ এবং ‘মুকাদ্দামাতু ইবনিস সালাহ’ শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ইবনে হাজার আসকলানী ও ইবনুস সলাহ লিখেছেন। ‘আততাসবিয়াতু বাইনা হাদ্দাসানা ওয়া আখবারানা’ প্রসিদ্ধ হানাফী মুহাদ্দিস ও ফকীহ তহাবী রহ. লিখেছেন। ‘তাওজীহুন নযর’ তাহের ইবনে সালেহ জাযায়েরী হানাফী লিখেছেন। ‘তাউযীহুল আফকার’ আমীরে সনআনী হানাফী লিখেছেন। ‘শরহু শরহি নুখবাতিল ফিকার’ মোল্লা আলী কারী হানাফী লিখেছেন। ‘কফবুল আসার ফী সফবি উলূমিল আসার’ রযিউদ্দীন মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম হানাফী লিখেছেন। ‘ইমআনুন নযর’ শায়খ আকরাম সিন্দী হানাফী লিখেছেন। ‘মুকদ্দামাতুশ শায়খ’ হানাফী মাযহাবের অনুসারী আব্দুল হক মুহাদ্দেসে দেহলবী লিখেছেন। ‘আররফউ ওয়াততাকমীল’ আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী লিখেছেন। ‘আততাকয়ীদ ওয়াল ঈযাহ’ ইবনে রজব হাম্বলী লিখেছেন। ‘আল ইলমা’ কাযী ইয়ায মালেকী লিখেছেন। এমনিভাবে উসূলে হাদীসের উপর আরো যত কিতাব আছে সবই কোনো না কোনো মুকাল্লিদ তথা মাযহাবের অনুসারী লিখেছেন। এখন প্রশ্ন হলো তাদের মতানুযায়ী এইসব মুশরিকদের কিতাব থেকে নেওয়া সহীহ, যয়ীফ এজাতীয় অন্যান্য পরিভাষা ব্যবহার করা তাদের জন্য কীভাবে বৈধ হবে?
 ৫. আহলে হাদীস সম্প্রদায় তথা যারা মাযহাব মানে না তাদের কোনো ধারাবাহিক সিলসিলা নেই। তারা নতুন উদ্ভাবিত দল। আর আমরা যারা মাযহাব মানি তাদের ধারাবাহিকতা আছে। ১৪শ বছর যাবত এই পৃথিবীতে মাযহাব মাননেওয়ালাদের কিতাব পড়া ও পড়ানো হচ্ছে। আহলে হাদীস সম্প্রদায় নতুন উদ্ভাবিত হওয়ার দলীল হলো তাদের জন্মই হয়েছে বৃটিশ সরকারের গর্ভে। বৃটিশরা এই উপমহাদেশ দখল করার আগে যদি তাদের কোনো অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে তারা ১২৪৬ হিজরীর আগে আহলে হাদীস সম্প্রদায় কর্তৃক  লেখা হাদীস, উসূলে হাদীস, তাফসীর, উসূলে তাফসীর, ফিকহ, উসূলে ফিকহ সম্পর্কীয় কোনো কিতাব দেখাক। তাদেরকে  অশেষ সময় দেওয়া হলো তারা উপরোক্ত ছয় বিষয়ে লিখিত ছয়টি কিতাব দেখাক। তাফসীর, হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কে লিখিত যে-সব কিতাব পৃথিবীর বুকে আছে তা সবই কোনো না কোনো মাযহাবের অনুসারী কিংবা মুজতাহিদ লিখেছেন। তারা মাযহাব মাননেওয়ালাদের কিতাব পড়ে আবার তাদেরকেই মুশরিক বলে কী আজব বৈপরীত্য !
 মুফতী মাহমূদল হাসান গাঙ্গুহী যিনি দেওবন্দের প্রধান মুফতী ছিলেন তিনি বলেন, হযরত মাওলান ইবরাহীম বালইয়াবী রহ. বলেন, আমার একজন আহলে হাদীস উস্তাদ ছিল। তিনি ফাতাওয়াও লিখতেন। আমি একদিন তার কামরায় প্রবেশ করে দেখতে পেলাম তখন দেখলাম, তিনি (হানাফী মাযহাবের ফিকহ এর প্রসিদ্ধ কিতাব) হেদায়া এবং ফাতাওয়া আলমগিরিয়্যাহ অধ্যায়ন করছেন। তখন আমি বললাম, হযরত আপনি তো আহলে হাদীস, হানাফীদের কিতাব অধ্যায়ন করছেন কেন? তিনি বললেন, এইসব কিতাব ছাড়া জুযইয়্যাত(খুঁটিনাটি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান) আর কোথায় পাব? এইসব কিতাব দেখেই ফাতাওয়া দেই কিন্তু দলীলের আলোচনায় এইসব কিতাবের নাম উল্লেখ করি না; বরং হেদায়ার মাসআলার দলীল হিসেবে হেদায়ার মতন ও টিকায় যে-সব হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সে-সব হাদীস দলীল হিসেবে উল্লেখ করে দেই। আর লিখে দেই, এই মাসআলা অমুক হাদীস থেকে সাবেত হয়েছে।(মালফূযাতে ফকীহুল মিল্লাত ২/৯১) আল্লামা ইবরাহীম বালইয়াবী সাহেবের উস্তাদ ঐ আহলে হাদীস আলেম স্পষ্ট স্বীকার করলেন যে, তারাও মূলত হানাফীদের কিতাবের প্রতি মুহতাজ। আর তারা হানাফীদের প্রতি মুহতাজ হবেই না বা কেন, তাদের তো কোনো কিতাব নেই। মুকাল্লি¬দদের লিখিত কিতাব ছাড়া তারা এক কদমও এগুতে পারবে না।
 ৬. আহলে হাদীস সম্প্রদায় যদিও বলে আমরা কারো তাকলীদ করি না, কিন্তু তারা বাস্তবে  মুহাদ্দিসীনদের তাকলীদ করে থাকে। কারণ, তারা কোনো বিষয়ের দলীল হিসেবে বুখারী  মুসলিম এজাতীয় অন্যান্য হাদীসের কিতাব থেকে হাদীস পেশ করে থাকে। যার অর্থই হলো তারা তাদের তাকলীদ করে। অথচ বড় বড় মুহাদ্দিসীন নিজেরা ফাতাওয়া না দিয়ে ফাতাওয়ার জন্য ফুকাহাদের কাছে যাওয়ার জন্য বলতেন। এর কারণ হিসেবে ইমাম তিরমিযী রহ. এর কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি তার সুনানে কিতাবুল জানায়েযের একটি হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, هكذا قال الفقهاء وهم اعلم بمعانى الحديث ‘ফকীহগণ  এই হাদীসের ব্যাপারে এমনটি বলেছেন, আর তারা হাদীসের অর্থ সবচেয়ে ভালো জানেন’। তিরমিযী হা.নং৯৯০
মুহাদ্দিসীনে কেরাম যে ফাতাওয়ার জন্য মুজতাহিদ ইমামদের কাছে যাওয়ার জন্য বলতেন এরকম দুইটি ঘটনা উল্লেখ করা হলঃ
প্রথম ঘটনাঃ সুলাইমান বিন মেহরান আল আ‘মাশ রহ. এর কাছে এক লোক ফাতাওয়া নিতে আসলে তিনি প্রশ্নকারীকে ইমাম আবূ ইউসূফ রহ. এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। (ইমাম আবূ ইউসুফ সুলাইমান বিন মেহরান এর ছাত্র ছিলেন। তিনি তার কাছে হাদীস পড়েছেন।) তো আবূ ইউসুফ রহ. প্রশ্নকারীর উত্তর দিয়ে দিলেন। তখন আ‘মাশ রহ. আবূ ইউসুফ রহ.কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই উত্তর কীভাবে দিলে? তখন তিনি বললেন, গতকাল আপনি যে হাদীস পড়িয়েছেন তার মধ্যেই তো এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। তখন তিনি বললেন, انتم الاطباء ونحن الصيادلة ‘আসলে তোমরা ডাক্তার আর আমরা ওষুধ বিক্রেতা’ অর্থাৎ ওষুধ বিক্রেতার কাছে যেমন অনেক ওষুধ থাকে কিন্তু কোন ওষুধ কোন রোগের জন্য তা তার জানা থাকে না ঠিক তেমনিভাবে এমন মুহাদ্দিস যে মুজতাহিদ না তার কাছে অনেক হাদীস থাকে, কিন্তু কোন হাদীস দ্বারা কোন মাসআলা সাবেত হয় তা তার জানা থাকে না। (আখবারু আবী হানীফ ওয়া আসহাবিহী, লিসসয়মারী পৃ.১২-১৩, আসারুল হাদীস...পৃ.১২৩)
 দ্বিতীয় ঘটনা: সদরুদ্দীন রহ. মানাকেবে আবূ হানীফা নামক কিতাবে লিখেছেন, একবার ইয়াযীদ ইবনে হারুন (যিনি অনেক বড় বড় মুহাদ্দিসদের উস্তাদ ছিলেন) এর কাছে একজন ফাতাওয়া চাইতে আসল। তখন তার কাছে তার ছাত্রদের মধ্যে থেকে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইয়াহইয়া বিন মাঈন, আলী ইবনুল মাদীনী, যুহাইর ইবনে হারব প্রমুখ মুহাদ্দিসীন  উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি মুস্তাফতীকে বললেন, তুমি ফাতাওয়ার জন্য এখানে এসেছ কেন? আহলে ইলমদের কাছে যাও। তখন আলী ইবনুল মাদীনী রহ. বললেন, হুজুর আপনার নিকট উপস্থিত এই বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারীগণ কি আহলে ইলম নয়! তখন তিনি বললেন, না তোমরা আহলে ইলম নও; বরং  তোমরা হলে আহলুল হাদীস (তথা হাদীস বিশারদ) আর আহলে ইলম হল আবূ হানীফার ছাত্ররা’ (ইরশাদুল কারী পৃ.৩২)
 এই দুই ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হলো, বড় বড় মুহাদ্দিসগণ ফাতাওয়ার জন্য ফুকাহা তথা মুজতাহিদ এর কাছে যাওয়ার জন্য বলতেন। এখন তথাকথিত আহলে হাদীসদের কাছে প্রশ্ন হলো ,তারা যে-সব মুহাদ্দিস ইমামদের তাকলীদ করে সেই মুহাদ্দিস ইমামগণ ফাতাওয়ার জন্য যাদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন তারা তাদেরকে মানে না কেন? এ ক্ষেত্রে তারা তাদের ইমামদের অনুসরণ করে না কেন? তারা কি এই প্রশ্নের কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব দিতে পারবে?  তাদের ইমামদের মান্যবর মুজতাহিদকে কি তারা মুশরিক বলতে পারবে?
৭. তথাকথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায় ইজমা ও কিয়াসকে শরীয়তের দলীল মানে না। অথচ ইজমা কিয়াস দলীল হওয়া কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। ইজমা দলীল হওয়া সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াত (ومن يشاقق الرسول من بعد ما تبين له الهدى ويتبع غير سبيل المؤمنين نوله ما تولى ونصله جهنم. سورة النساء:১১৫ ) দ্বারা প্রমাণিত। কারণ এই আয়াতের মাধ্যমে মুফাসসির এবং উসূলী উলামায়ে কেরাম ইজমা শরীয়তের দলীল হওয়া প্রমাণ করেছেন। আর সুরা হাশরের ২ নং আয়াত (فاعتبروا يا اولى الالباب. سورة الحشر:২ ) দ্বারা কিয়াস শরীয়তের  দলীল হওয়া প্রমাণিত হয়। তাছাড়া হাদীসের কিতাবে নবীজী সা. এবং সাহাবায়ে কেরামের কিয়াসের ভূরিভূরি প্রমাণ রয়েছে। (কেউ বিস্তারিত জানতে আগ্রহি হলে মাসিক আল আবরারে প্রকাশিত ‘সিরাতে মুস্তাকীম’ শিরোনামে আমার ধারাবাহিক লেখা পড়ে নিবেন, সেপ্টেম্বর ২০১২ ঈ. থেকে শুরু।)
 আহলে হাদীস সম্প্রদায় ইজমা-কিয়াসকে শরীয়তের দলীল না মানায় তারা  اليوم اكملت لكم دينكم ...سورة المائدة:৩ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম’( মায়েদা:৩) এই আয়াতকে অস্বীকারকারী সাব্যস্ত হয়। কেননা এমন হাজার হাজার মাসআলা আছে যার সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না। এ সব ক্ষেত্রে ফকীহগণ ইজমা অথবা কিয়াস এর মাধ্যমে সমাধান দিয়ে থাকেন। যারা ইজমা এবং কিয়াসকে শরীয়তের দলীল মানবে না তারা ঐসব মাসআলার সমাধান কীভাকে দিবে? এবং আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা ‘আমি আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’ এর বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব হবে? এখানে এমন কয়েকটি মাসআলা উল্লে¬খ করা হলো আমাদের জানা মতে যার সমাধান সরাসরি কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না। আহলে হাদীস সম্প্রদায়কে এই সমস্ত মাসআলার সমাধান কোনো প্রকার কিয়াসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া  স্পষ্ট কুরআনের আয়াত কিংবা স্পষ্ট হাদীস দ্বারা দেওয়ার অনুরোধ করা হলো।
১.    ডেসটিনি ২০০০লি. জায়েয হবে কিনা?
২.    প্রাইজ বন্ড কেনা জায়েয হবে কিনা?
৩.    প্রভিডেন্ড ফান্ড বা জি.পি ফান্ডের টাকা ও লভ্যাংশ গ্রহণ করা জায়েয হবে কিনা?
৪.    বর্তমান শেয়ার বাজারে শেয়ার ক্রয় বিক্রয় জায়েয হবে কিন?
৫.    প্লাস্টিক সার্জারি করা জায়েয হবে কিনা?
৬.    বীমা-ইন্সুরেন্স করা জায়েয হবে কিনা?
৭.    ট্রেডমার্ক বেচা-কেনা জায়েয হবে কিনা?
৮.   দেশি-বিদেশি কাগজের নোট পর¯পরে কম-বেশি মূল্যে ক্রয়-বিক্রয় জায়েয হবে কিনা?
৯.   এ্যাডভান্সের টাকা গ্রহণ করা ও ব্যবহার করা জায়েয হবে কিনা?
১০. শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা বা দান করা  জায়েয হবে কিনা?
১১. বিমানে নামায পড়া জায়েয হবে কিনা?
১২. রোযা অবস্থায় ইনজেকশন নেওয়া জায়েয কিনা?
এখানে হাজার হাজার আধুনিক মাসায়েলের মধ্য থেকে মাত্র বারটি মাসআলা উল্লেখ করা হলো। তারা সক্ষম হয়ে থাকলে, কোনো প্রকার কিয়াসের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া অন্তত এই বারটি মাসআলার সমাধান যেন কুরআনের স্পষ্ট আয়াত বা স্পষ্ট হাদীস দ্বারা দেয়। এর জাওয়াব না দিতে পারলে তারা ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’ এই আয়াত অস্বীকারকারী প্রমাণিত হবে। যার ফলে তারা বে-ঈমান প্রমাণিত হবে।
 ৮. কোনো মাসআলা তাদেরকে বললে তারা বলে, আপনি সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ হাদীস দিয়ে দলীল দিলে আমরা মানতে রাজি আছি। আমি তাদেরকে বলব, আপনারা সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল মারফু হাদীস কাকে বলে তথা এই  হাদীসের সংজ্ঞা যদি কুরআনের আয়াত বা হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমরা প্রত্যেক মাসআলা সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল,মারফূ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে পারব। তাদের পক্ষে সম্ভব হলে, তারা যেন কুরআন কিংবা হাদীস দ্বারা সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ হাদীসের সংজ্ঞা প্রমাণ করে দেখায়। অথবা শুধু এতটুকু প্রমাণ করে দেখায় যে, নবীজী সা. শুধু সহীহ, সরীহ, মুত্তাসিল, মারফূ হাদীসই মানতে বলেছেন। অন্য কোনো হাদীস মানতে নিষেধ করেছেন।
 ৯. আহলে হাদীস তথা যারা কোনো ইমাম মানে না তাদের কাছে সবিনয় আরয এইযে, আপনাদের মতে তো মুকতাদীর ফাতেহা পড়া ছাড়া তার নামায হয় না অর্থাৎ মুকতাদীকে ইমামের পিছনেও ফাতেহা পড়তে হবে। তাই আপনাদের কাছে প্রশ্ন হলো, যদি আপনাদের কেউ এমন সময় মসজিদে উপস্থিত হয় যখন ইমাম সাহেব কিরাআত শেষ করে রুকুতে চলে গেছেন, তখন আপনারা তাকে  কী করতে বলবেন? অর্থাৎ তার ফাতেহা পড়ার ব্যাপারে আপনারা কী বলবেন? যদি বলেন, সে রুকূতে ফাতেহা পড়ে নিবে। তাহলে আমরা বলব নবীজী সা. রুকু-সেজদার মধ্যে কুরআন পড়তে নিষেধ করেছন। আর ফাতেহা কুরআনের অংশ হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত। অতএব রুকূতে ফাতেহা পড়া যাবে না। (তিরমিযী হা.নং২৬৪, তিরমিযী রহ. এই হাদীসকে ‘হাসানুন সহীহুন’ বলেছেন।) যদি বলেন, সে এইরাকাআতে শরীক হবে না দাঁড়িয়ে থাকবে, পরবর্তী রাকাআত থেকে ইকতেদা করবে। তাহলে আমরা বলব, নবীজী সা. ইমামকে যে অবস্থায় পাওয়া যায় সে অবস্থায় ইকতেদা করতে বলেছেন। ( তিরমিযী হা.নং ৫৯১, আলবানী সাহেবও এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। সহীহা হা.নং১১৮৮) অতএব দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। যদি বলেন, ইমামের সাথে শরীক হব কিন্তু এই রাকাআত গণনা করব না। তাহলে আমরা বলব, নবীজী সা. রুকূ পেলে রাকাত গণনা করতে বলেছেন। (আবূদাউদ হা.নং৮৯৩, আলবানীর তাহকীক, তিনিও হাদিসটিকে  হাসান বলেছেন) অতএব রুকূ পেলে রাকাআত না ধরার কোনো উপায় নাই। যদি বলেন, ফাতেহা না পড়ে ইমাম যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় ইমামের ইকতেদা করব। তাহলে আমরা বলব, আপনার মতানুযায়ী তো ফাতেহা পড়া ছাড়া মুকতাদীর নামাযই হয় না। তো এই উত্তরের সুযোগও আপনার নেই।
 ১০. এমনিভাবে আপনাদের কেউ যদি এমন সময় মসজিদে আসে যখন ইমাম সাহেব সূরা ফাতেহার শেষাংশ ولاالضالين  পড়ছেন। তখন আপনারা তাকে কী করতে বলবেন? আপনারা যেহেতু হাদীস মানেন, তাই হাদীস অনুযায়ী উত্তর দিবেন। যদি বলেন, ইমামের সাথে সেও আমীন বলবে। কারণ, হাদীসে এসেছে ‘ইমাম যখনولاالضالين  বলে তখন তোমরা আমীন বল।’ (বুখারী হা.নং৭৮২) তাহলে আমরা বলব, তার জন্য তো ফাতেহা পড়া জরুরী। ফাতেহা পড়া ছাড়া তার নামাযই হবে না। তাহলে ফাতেহা না পড়েই কীভাবে সে আমীন বলবে? যদি বলেন সে ইমামের ولاالضالين শুনা সত্ত্বেও আমীন বলবে না; বরং আগে ফাতেহা পড়ে নিজে নিজে আমীন বলবে। তাহলে আমরা বলব, ‘ইমাম যখন ولاالضالين  বলে তখন তোমরা আমীন বল’ এই হাদীসের উপর কীভাবে আমল হবে?
 আপনারা কোনো হাদীসের বিরোধিতা না করে এই প্রশ্নগুলির গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে পারলে আমরা খুবই বাধিত হব। আর যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর আপনাদের কাছে না থাকে, তাহলে আমরা আপনাদেরকে ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। সেক্ষেত্রে আপনাদের কোনো হাদীসেরই বিরোধিতা করতে হবে না। কারণ উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলোর কারণে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত এই যে, ফাতেহা পড়া ছাড়া নামায না হওয়ার হাদীসটি ইমাম ও একাকী নামায আদায়কারী জন্য প্রযোজ্য। অতএব মুকতাদী এসে ইমামকে যে অবস্থায় পাবে সে অবস্থায় ইমামের সাথে শরীক হয়ে যাবে। তার ফাতেহা পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এমনিভাবে হানাফী মুকতাদীর জন্য আমীন বলতেও কোনো ঝামেলা নেই। কারণ তার জন্য ফাতেহা পড়ার বিধান নেই। অতএব সে ইমামের ولاالضالين শুনে আমীন বলতে পারবে। আর এতে তার কোনো হাদীসের বিরোধীতাও করতে হবে না।
 আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং সবাইকে সিরাতে মুস্তাকীমের উপর কায়েম দায়েম থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
-- সমাপ্ত
  • শাইখুল হাদীস আল্লামা মুফতী মনসূরুল হক (দা:বা:)জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া, মুহাম্মাদপুর-ঢাকা।

1 comment:

  1. বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ইসলাম মনে হয়ে দেওবন্দ থেকে নাযিল হয়

    ReplyDelete