Tuesday, 22 July 2014

শরীয়ত ও ইতিহাসের আলোকে জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী

রবীউল আউয়াল চাঁদের ১২ তারিখ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে আমাদের দেশেঈদে মীলাদুন্নবী’ পালিত হয় এবং এতদুদ্দেশ্যে জশনেজুলুস ও উরসুন্নবীর আয়োজন-অনুষ্ঠানও করা হয়। কোন কোন মহলের পক্ষ থেকে এসব আয়োজন-অনুষ্ঠানকে নবীপ্রেমের শ্রেষ্ঠ আলামত রূপে আখ্যায়িত করে তদপ্রতি বিশেষ তাগিদ ও উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং এসব আনুষ্ঠানিকতায় যারা সংশ্লিষ্ট হয় না তাদেরকে নানা তিরস্কার ও বিদ্রুপ বানে জর্জরিত করা হয়। তাই এই নিবন্ধে ইতিহাস ও শরীয়তের দৃষ্টিকোণে ঈদে মীলাদুন্নবীজুলুস-মিছিল এবং প্রচলিত মীলাদ মাহ্ফিলেরখতিয়ান পেশ করা হল
প্রথমে একথা জানা থাকা আবশ্যক যেহযরত রাসলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রেম ও ভালবাসা হল ঈমানের পর্বশর্ত। বিশুদ্ধ বর্ণনা অনুসারে তাঁর সাথে সম্পর্কিত বিষয় ও তাঁর সুন্নাত-তরীকার প্রতি আন্তরিক মুহাব্বত এবং সে মতে জীবন নির্বাহ হল ঈমানের স্পষ্ট আলামত ও নাজাতের একমাত্র উসীলা। এতে কারো আপত্তি নেই এবং থাকার কথাও নয়
কিন্তু প্রশ্ন হলপ্রচলিত নিয়মে প্রতি বছর রবীউল আউয়াল চাঁদে এবং বিশেষ করে এ মাসের নয় ও বার তারিখকে নির্দিষ্ট করে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপব্যয় করে ঈদে মীলাদের জশ্নে-জুলুসের ব্যবস্থা করাঅতীব জাঁকজমকের সাথে মাহ্ফিলের আয়োজন করা কিংবা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে এদিন গুলোকে নির্দিষ্ট করা এবং তজ্জন্য গরু-ছাগল জবাই করাকে জরুরী মনে করা কি কুরআন-হাদীসইজমায়ে উম্মত প্রভৃতি শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিতঅথবা তিন শ্রেষ্ঠ যুগ অর্থাৎ সাহাবাতাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের যুগে কি এসব কাজের প্রচলন ছিলসে কথা যাচাই করাই এ আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য
বলা বাহুল্যমানুষের পছন্দ-অপছন্দের উপর দ্বীন-ধর্ম নির্ভরশীল নয়। তেমনি ব্যাপক জনগণের রুচি-অভিরুচিকেও সুন্নাত বলা যায় না। বরং শরীয়তের দলীল-প্রমাণ দ্বারা যা প্রমাণিত হয়তাই দ্বীন ও সুন্নাত। প্রমাণবিহীন কাজ-কর্মকে সাওয়াবের কাজ মনে করা হলে বিদ্আতে পর্যবসিত হয়শরীয়তের দৃষ্টিতে বিদ্আত কাজ হল অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং দ্বীনে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। মোটকথাইসলাম ধর্মে হক ও বাতিল এবং গুনাহ্ ও সাওয়াবের মাপকাঠি হল শরীয়তের দলীলমানুষের অভিরুচি নয়

শরীয়তের দলীলঃ
(১) শরীয়তের প্রথম ও প্রধান দলীল হল পবিত্র কুরআন মাজীদযা অপরিবর্তনীয় এক শাশ্বত এবং পরিপর্ণ জীবন বিধান
(২) শরীয়তের দ্বিতীয় দলীল হলপবিত্র হাদীস শরীফ। স্বয়ং কুরআন মাজীদ স্থানে স্থানে হাদীসকে শরীয়তের দলীল রূপে অভিহিত করেছে
(৩) শরীয়তের তৃতীয় দলীল উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য। তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- আল্লাহ্ মুহাম্মদের উম্মতকে গোমরাহীর উপর একমত রাখবেন না হাদীসটি একথার প্রমাণ বহন করে যেউম্মতের ঐকমত্য সত্য ও বিশুদ্ধ
(৪) কুরআন-হাদীসের পর খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত ও তরীকা এবং অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামের বাণী আর ধরাবাহিক আমলও শরীয়তের দলীল
(৫) খুলাফায়ে রাশিদীন এবং সাহাবায়ে কিরামের পর তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের যুগের উলামাদের কোন কাজ করা বা বর্জন করাকে শরীয়ত বড় গুরুত্ব দান করে। সে কারণে তাঁদের অনুসরণ করাও মুসলমানদের কর্তব্য
(৬) ক্বিয়াস এবং ইস্তিহ্সানও শরীয়তের অন্যতম দলীল এবং কুরআন-হাদীস ও ইজমার পরে তার স্থান
এ সংপ্তি আলোচনার পর জেনে রাখা উচিত যেকুরআন-হাদীস ও শরীয়তের অন্যান্য দলীল-প্রমাণের আলোকে অনুসন্ধান করলে স্পষ্ট হয় যেপ্রতি রবীউল আউয়াল চাঁদে জশ্নে-জুলুসের ব্যবস্থা ও প্রচলিত নিয়মে মীলাদ মাহ্ফিলের আয়োজন ইত্যাদি শরীয়তের উল্লিখিত কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়
কুরআন মাজীদের ১১৪টি সরা৫৪০টি রুকূ,৬৬৬টি আয়াত এবং ৩,২২,৬৭১টি অরের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন কোথাও এর প্রমাণ পাওয়া যাবে না। অনুরূপ সিহাহ্ সিত্তার হাদীস গ্রন্থসমহ এবং অপরাপর হাদীস গ্রন্থ যথা মুয়াত্তা মালেকমুসনাদে ইমাম আহ্মদদারমী ও তাহাবীমুসান্নাফে ইব্নে আবী শাইবামুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাককান্যুল উম্মালমুসতাদরাকে হাকেমবাইহাকী ও দারাকুতনী প্রভৃতি ছোট বড় হাদীস গ্রন্থসমহের কোথাও এসব আচার-অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তেমনি ফিক্বাহ্ শাস্ত্রের কিতাব যেমন- মাবসসিয়ারে কবীরহিদায়াহ্ফাতল ক্বাদীর,বাদাইউস্ সানায়ে’, আল-বাহরুর রায়েক্বফাতওয়ায়ে শামী ও আলমগিরিয়্যাহ্ প্রভৃতি ছোট বড় অজস্র কিতাবের কোন একটিতে এর সামান্যতম ইঙ্গিতও দেখা যায় না। তদুপরি ইজমায়ে উম্মত দ্বারা এটি প্রমাণিত হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কেননাইসলামের প্রথম ছয় শতাব্দী পর্যন্ত এর কোন নজীর পাওয়া যায় না। বরং এর উদ্ভাবন কাল থেকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দায়িত্বশীল উলামায়ে কিরাম এসব আচার-অনুষ্ঠানের কড়া সমালোচনা করে আসছেন। বিস্তারিত তথ্য পরে আসছে
উল্লেখ্যশরীয়তের চতুর্থ দলীল ক্বিয়াস এবং ইস্তিহ্সান দ্বারাও তা প্রমাণ করা যায় না। চার মাযহাবের মহান চার ইমাম এবং ইমাম আউযাঈইমাম সুফিয়ান সাউরীইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রাহ্.) প্রমুখ সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুজতাহিদীনে কিরামযাদের ক্বিয়াস ও ইস্তিহ্সান শরীয়তে গ্রহণযোগ্যতাঁদের কেউ প্রচলিত নিয়মের মীলাদুন্নবী উদযাপন করেছেন বলে প্রমাণ নেইপরবর্তী যুগে ক্বিয়াস ও ইস্তিহ্সান দ্বারা যারা মীলাদুন্নবীর প্রচলিত নিয়মকে প্রমাণিত বলে মনে করেনতাদের মধ্যে ক্বিয়াসস্তিহ্সান ও ইজতিহাদের সামান্যতম যোগ্যতাও নেই। (কুতুবে তবকাতে ফুক্বাহা)
মোটকথাখিলাফতে রাশিদার ত্রিশ বছরেএকশত দশ হিজরী পর্যন্ত সাহাবীগণের যুগেএকশত সত্তর হিজরী পর্যন্ত তাবিঈনের যুগে এবং প্রায় দুইশত বিশ হিজরী পর্যন্ত তাবে তাবিঈনের যুগে প্রচলিত মীলাদের কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ দুনিয়ার বুকে নবীপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে গেছেন তাঁরাই। উহদ যুদ্ধে সাহাবী হযরত ত্বাল্হা (রাযি.) আপন শরীর দ্বারা রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আড়াল করে রেখে ছিলেন। ফলে তাঁর শরীরে সত্তরটির মত শত্রু পক্ষের তীর বিদ্ধ হয়েছিল। অন্য এক সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্নে যায়েদ রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের শোকে মুহ্যমান হয়ে দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ্! আমাকে অন্ধ করে দাওযেনএই চোখ দিয়ে প্রিয়নবীর পরে আর কাউকে দেখতে না হয় বর্ণিত আছে যেতিনি বাস্তবিকই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আরেক মহিলা সাহাবীযার পিতাস্বামী ও ভাই উহদ যুদ্ধে শহীদ হয়ে ছিলেনতিনি রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে বলেছিলেন, “ইয়া রাসলাল্লাহ্! আপনাকে পাওয়ার শর্তে আমার জন্য যে কোন মুসীবত সহ্য করা অতি সহজ
অনুরূপ হুদাইবিয়ার সন্ধিণে তাঁর পবিত্র মুখ থেকে যে থু থু ফেলছিলেনতা মাটিতে পড়ার আগেই সাহাবায়ে কিরাম পরম সম্মানের সাথে হাতে তুলে নিজেদের মুখে মেখে নেন। তাঁর শরীর মুবারক থেকে কোন চুল খসে পড়তে না পড়তেই সাহাবীগণ তা হাতে নিয়ে নিতেন। (সীরাতুল মুস্তফা,তানযীমুল আশতাত)
দুনিয়ার ইতিহাসে প্রেম-ভালবাসার এমনতর নজীর কি দ্বিতীয়টি আছেএ নজীরবিহীন প্রেম-ভালবাসার প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগেসাহাবায়ে কিরাম ভালবাসা ও সম্মান জ্ঞাপনের নিদর্শন স্বরূপ মীলাদুন্নবী ও জুলুস-মিছিলের কথিত এই আয়োজন-অনুষ্ঠান কি কোন সময় করেছিলেনঅতঃপর তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের যুগেও কি প্রেম-প্রীতি ও মর্যাদা জ্ঞাপনের এই উদাহরণ স্থাপিত হয়েছিলযদি হয়ে থাকে তবে কোন উম্মতের ভিন্নমত পোষণ করার অবকাশ নেই। মীলাদ পড়ূয়া মহলের সাথে আমরাও একমত হতে বাধ্য হব। কিন্তু যদি প্রমাণ করতে না পারে (ইন্শাআল্লাহ্,ক্বিয়ামত পর্যন্ত পারবে না) তাহলে যে কাজ তিন শ্রেষ্ঠ যুগ অর্থাৎ সাহাবীতাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের যুগে উত্তম ও সাওয়াবের কাজরূপে কোন সময় পালিত হয়নিতা আজ কিরূপে অসীম বরকতের কাজ বলে গণ্য হতে পারে?
এ ব্যাপারে হযরত ইমাম মালিক (রাহ্.)এর মল্যবান বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “এই উম্মতের পরবর্তী যুগকে ঐ পন্থায় সংশোধন করা যাবে যে পন্থায় প্রথম যুগ সংশোধন হয়েছিল(ইক্তিযাউস্ সিরাতিল মুস্তাক্বীম-৩৬৭)
কেবল এই মৌলিক কথাটির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চিন্তা করা হলে স্পষ্ট হয়ে যাবে যেএসব আচার-অনুষ্ঠান কি সত্যি সুন্নাত ও নবীপ্রেমের কাজনা বিদ্আত এবং নবীজির রূহ্ মুবারকের অসন্তুষ্টিরই কারণ?

মীলাদ মাহ্ফিলের ইতিকথাঃ
উপরোক্ত আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যেশরীয়তের কোন দলীল এবং তিন মুবারক যুগের মহান চার খলীফা ও সাহাবীতাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের কোন আমল দ্বারা প্রচলিত নিয়মের মীলাদ মাহ্ফিল ও জুলুস-মিছিলের আয়োজন-অনুষ্ঠান সাব্যস্ত নয়। এমন কি উম্মতের পরবর্তী বড় বড় ইমাম যথা ইমাম আবু হানিফাইমাম শাফিঈইমাম আহ্মদ ইব্নে হাম্বল ও ইমাম মালিক (রাহ্.) অতঃপর বড় বড় মুহাদ্দিস যথা ইমাম বুখারীইমাম তিরমিযীইমাম মুসলিম ও ইমাম আবুদাঊদ (রাহ্.) প্রমুখের আমলে এই মীলাদ মাহ্ফিলের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে বড় পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রাহ্.)হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমীরী (রাহ্.) প্রমুখ যুগ বরেণ্য সফী সাধকগণও এ ধরনের আয়োজন-অনুষ্ঠান কখনও করেননি
তাহলে প্রশ্ন জাগেএই মীলাদের সত্র কি এবং এর জন্ম কোথায়এ ব্যাপারে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে যে তথ্য পাওয়া যায় তাহলো৬০৪ হিজরী সালে ইরাকের মুসিল শহরে বাদশাহ্ আবু সাঈদ মুজাফ্ফর কুকুবুরী (মৃতঃ ৬৩০ হিজরী) ও আবুল খাত্তাব উমর ইব্নে দিহ্য়া নামক জনৈক দরবারী আলেম দ্বারা সর্বপ্রথম এর গোড়াপত্তন হয়। ১২ রবীউল আউয়াল ভিত্তিক এই অনুষ্ঠানের ল্য ছিল আনন্দ উৎসব এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য ঈসালে সাওয়াব উদ্দেশ্যে যিয়াফতের ব্যবস্থা করা। (তারীখে ইব্নে কবীর-১৩/১৩৬তারীখে ইব্নে খাল্লিক্বান-৪/১১৭,ইখ্তিলাফে উম্মত ও সীরাতে মুস্তাক্বীম-১/৮৩ পৃষ্ঠা)
মীলাদের গোঁড়া সমর্থক মৌলবী আহ্মদ রেজা খাঁ বেরলবীর বিশিষ্ট খলীফা মৌলবী আব্দুচ্ছমী রামপুরী সাহেবও সে কথা স্বীকার করেন। তার ভাষায়, “রবীউল আউয়ালের ১২ তারিখ আনন্দ-উল্লাস ও মীলাদ মাহ্ফিলের আয়োজন-অনুষ্ঠানের জন্য যে নির্দিষ্ট করা হয়তা করা হয় ৬শ’ হিজরী সনের শেষ ভাগে (আন্ওয়ারে সাতেয়া-১৬৩)
যে বাদশার ব্যবস্থাপনায় জাঁকজমকপর্ণ মীলাদের আয়োজন করা হততিনি কোন্ প্রকৃতির ছিলেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন ইমাম আহ্মদ ইব্নে মুহাম্মদ মালেকী (রাহ্.)এর মন্তব্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়তিনি লিখেন- সে ছিল এক অপব্যয়ী বাদশা। সে নিজস্ব ইজতিহাদ ও অভিরুচি মতে আমল করার জন্য সমকালীন আলেমদের আদেশ দিত এবং অন্য ইমামের অনুসরণ না করার জন্য উৎসাহ যোগাত। ফলে (স্বার্থপর) আলেমদের একটি দলকে সে বাগিয়ে নিয়েছিল। সে প্রতি রবীউল আউয়াল মাসে মীলাদ অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সেই প্রথম বাদশা যে এই নবতর প্রথার ভিত্তি স্থাপন করে (আল কাউলুল মুতামাদ ফী আমালিল মাওলীদমিন্হাযুল ওয়াযিহ্-২৪৯)
এই অপব্যয়ী বাদশা প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য ধর্মের নামে বাইতুল মালের ল ল টাকা মীলাদুন্নবীর আয়োজনে পানির মত ব্যয় করত। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক আল্লামা যাহাবী (রাহ্.) তার সম্পর্কে লিখেন, “সে প্রতি বছর মীলাদুন্নবী উপল্েয প্রায় তিন ল দিনার ব্যয় করত (দুয়ালুল ইসলাম-২/১৩৬)
আল্লামা ইব্নে কাসীর ও আল্লামা ইব্নে খাল্লিক্বান (রাহ্.) লিখেন, “কোন কোন মীলাদ মাহ্ফিলে সেই বাদশার দ¯রখানে পাঁচ হাজার ভূনা মাথাদশ হাজার মুরগী এবং ত্রিশ হাজার হালুয়ার পাত্র থাকতমাহ্ফিল স্থানে স্থাপন করা হত বিশটিরও অধিক চার পাঁচ তলা বিশিষ্ট গম্বুজ। তন্মধ্যে একটি গম্বুজ বাদশার জন্য নির্দিষ্ট থাকত। অবশিষ্ট গম্বুজগুলোতে অবস্থান করত বাদশার উজির-নাজির ও সভাসদবর্গ। সফর মাস থেকেই শুরু হত গম্বুজ সাজানোর কাজ। এ মাহ্ফিলে অত্যন্ত ধুমধামের সাথে নাচ-গানের আসর বসত। বাদশা নিজেও নাচে অংশগ্রহণ করত। মাহ্ফিল শেষে যোগদানকারীদের যথাযোগ্য সম্মানীও দেওয়া হত (তারীখে ইব্নে কাসীর-১৩/১৩৭তারীখে ইব্নে খাল্লিক্বান-৪/১১৭-১১৯)
সুপ্রসিদ্ধ দুয়ালুল ইসলাম ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায়উপরোক্ত অপব্যয়ী বাদশার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মীলাদ মাহ্ফিলের বৈধতা ব্যাখ্যা করে আবুল খাত্তাব উমর ইব্নে দিহ্য়া (মৃতঃ ৬৩৩ হিজরী) আত-তানবীর ফী মাওলিদিস্ সিরাজিল মুনীর নামক একটি কিতাব রচনা করেছিলএজন্য সে বাদশার পক্ষ থেকে এক হাজার দিনার বখশিশ লাভ করেছিল। (খন্ড-২পৃষ্ঠা-১৩)। এই মৌলবী সম্পর্কে আল্লামা হাফেজ ইব্নে হাজার আসক্বালানী (রাহ্.) লিখেন, “সে পর্ববর্তী ইমাম ও আলেম-উলামাদের সাথে বেআদবী করত। সে ছিল অশ্লীল ভাষীঅহঙ্কারীনির্বোধ এবং দ্বীন সম্পর্কে সংকীর্ণমনা ও অলস প্রকৃতির (লিসানুল মীযান-৪/২৯৬আল্ মিন্হাযুল ওয়াযিহ্)। তিনি আরও লিখেন, “আল্লামা ইব্নুন্ নাজ্জার মন্তব্য করেন যেআমি এই মৌলবীর মিথ্যাচার ও দুর্বলতা সম্পর্কে লোকদের একমত দেখেছি (লিসানুল মীযান-৪/২৯৬আল্ মিনহাযুল ওয়াযিহ্)
উপরোক্ত ঐতিহাসিক আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যেপ্রচলিত মীলাদ মাহ্ফিলের গোড়াপত্তন হয়েছিল সাহাবীতাবিঈন এবং সাল্ফে সালিহীনের যুগের অনেক পরে এক অপব্যয়ী বাদশা ও তার দোসর এক স্বার্থপর মৌলবী দ্বারা। এর উদ্দেশ্য হলবিপুল অপব্যয়ে ধর্মের নামে লোকদের আকৃষ্ট করা এবং উদরপর্তির একটি উসীলা সৃষ্টি করাযা পরবর্তী মীলাদপন্থী মৌলবীদের মধ্যেও প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। তাই এ কাজ সাওয়াবের নয়বরং বিদ্আত তথা ইসলামে একটি নুতন বিষয়ের সংযোজন
ইমাম মালেক (রাহ্.) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, “যে কাজ রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের যুগে ছিল নাতা আজ দ্বীন হতে পারে না (আল্ ইতিসামখন্ড-১)পরবর্তীকালে বেশ কিছু সরলমনা মুসলমান এবং অপরিণামদর্শী আলেম মীলাদের এই প্রথার সাথে জড়িয়ে পড়েন। কোন এক আরবী কবি বড় আক্ষেপের সাথে বলেনঃ রাজা-বাদশামতলববাজ আলেম এবং স্বার্থবাদী সাধকদের কারণেই ধর্মের যা কিছু নষ্ট হল
অবাক হওয়ার কথাশরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেইসেই মীলাদ মাহ্ফিলের সাথে ইদানিংকালেঈদ শব্দটিও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ইসলামের গোটা ইতিহাসে ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহা ছাড়া তৃতীয় কোন ঈদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সাহাবাতাবিঈন এবং আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের হক্কানী উলামায়ে কিরাম এ দুদিন ছাড়া আর কোন দিনের সাথে ঈদ শব্দ যোগ করেননি। সুতরাং এটা দ্বীন বিকৃতি ছাড়া আর কি হতে পারেজানি নাসামনে এই এক বিদ্আত মীলাদের সাথে আরও কত প্রকারের বিদ্আত যুক্ত হবে
বর্তমানে কোন কোন এলাকায় ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ টাকা অপব্যয় করে বিপুল আয়োজনে জুলুস ও শানদার মিছিলেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যুক্তি দেখানো হচ্ছে যেএতে ইসলামের শান-শওকত প্রকাশ পায় এবং মুসলিম সমাজে নবচেতনা সৃষ্টি হয়। অথচ ইসলামের দুই মহান ঈদের দিনে এই বন্ধুরা মীলাদ মাহ্ফিলের মত বা তার অর্ধ্বেক পরিমাণেও কোন জুলুস-মিছিলের আয়োজন করেন না। বস্তুতঃ ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনে যদি মঙ্গলের কিছু থাকত বা নবীপ্রেমের আলামত হত,তাহলে সাহাবায়ে কিরাম কোন অবস্থাতেই এ কাজ থেকে বিরত থাকতেন না। কারণতাঁরা নবীর উদ্দেশ্যে জান-মাল সব কিছু বিসর্জন দিয়েছিলেন এবং তাঁদের কাছে নবীর একটি সুন্নাত উভয় জাহান থেকেও মল্যবান ছিল
এতদসত্ত্বেও তাঁরা ঈদে মীলাদুন্নবীউরসুন্নবীপ্রচলিত ক্বিয়াম ইত্যাদি প্রথা-রসমের সৃষ্টি করেননিঅতএববুঝা গেলমীলাদুন্নবী নামের প্রচলিত কার্যক্রম নবীপ্রেমের আলামতও নয় এবং তা দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত বা সাওয়াবের কাজও নয়

মীলাদুন্নবী ও হক্কানী উলামাঃ
এখানে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যেএকজন অপব্যয়ী বাদশা এবং একজন স্বার্থপর আলেমের হাতে যে মীলাদ অনুষ্ঠানের উৎপত্তিতৎকালের উলামায়ে হক্কানী সেই মীলাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন কি-না?
জবাবে বলতে হয়যুগ যুগ ধরে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের উলামায়ে কিরাম নবাবিস্কৃত এই প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও বাদ-প্রতিবাদ করে এসেছেন। নিম্নে কতিপয় যুগবরেণ্য আলেমের উদ্ধৃতি পেশ করা হল
১) আল্লামা তাজুদ্দীন ফাকেহানী (রাহ্.) ছিলেন মীলাদ উদ্ভব কালের একজন সুপ্রসিদ্ধ আলেম। তিনি মীলাদের প্রতিবাদে এক মল্যবান কিতাব রচনা করেছেন। কিতাবটির নাম আল্ মাওরিদ ফিল কালামি আলাল মাওলিদ। উক্ত গ্রন্থে তিনি লিখেন, “মীলাদের এই প্রথা না কুরআনে আছেনা হাদীস শরীফে। আর না পর্বসরীদের থেকে তা বর্ণিত আছে। বরং এটি একটি বিদ্আত কাজযাকে বাতিলপন্থী ও স্বার্থপরগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। আর পেট পজারীরা তা লালন করেছে।” (বারাহীনে ক্বাতেয়া-১৬৪হিওয়ার মাআল মালিকী-১৯৪ পৃষ্ঠা)
২) আল্লামা হাফেজ ইব্নে হাজার আসক্বালানী শাফী (রাহ্.)কে প্রশ্ন করা হয়মীলাদ অনুষ্ঠান কি বিদ্আতনা শরীয়তে এর কোন ভিত্তি আছেজবাবে তিনি বলেন, “মীলাদ অনুষ্ঠান মলতঃ বিদ্আত। তিন পবিত্র যুগের সালফে সালিহীনের আমলে এর অস্তিত্ব ছিল না (হিওয়ার মাআল মালিকী-১৭৭ পৃষ্ঠা)
৩) ইমামুল হিন্দ হযরত শায়েখ আহ্মদ সরহিন্দী মুজাদ্দিদে আল্ফে সানী হানাফী (রাহ্.) যাঁকে মীলাদ সমর্থক আলেমগণও মুজাদ্দিদ বলে স্বীকার করেনতাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়মীলাদ মাহ্ফিল অনাচার মুক্ত হলেও তাতে দোষের কিছু আছে কিতিনি বলেন, “আমি মনে করি যতণ পর্যন্ত এর দরজা সম্পূর্ণ বন্ধ হবে নাস্বার্থপর লোকেরা এর থেকে বিরত থাকবে না। যদি এর কিঞ্চিৎ জায়েয হওয়ার ফাত্ওয়া দেওয়া হয়তবে জানি না ব্যাপারটি ক্রমশঃ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।” (মাকতুবাতে ইমাম রব্বানীদপ্তর-৩মাকতুব-৭২)
৪) হযরত শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলবী হানাফী (রাহ্.)কে জিজ্ঞাসা করা হয়রবীউল আউয়াল মাসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে এর সাওয়াব রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহে পৌঁছানোতেমনি মুহাররম মাসে হযরত হুসাইন ও অন্যান্য আহ্লে বাইতের ঈসালে সাওয়াব উদ্দেশ্যে খানাপিনার আয়োজন করা কি জায়েযউত্তরে তিনি বলেন, “নিজের আমলের সাওয়াব কোন বুযুর্গ ব্যক্তিকে বখশিশ করার ইখতিয়ার মানুষের আছে। তবে এর জন্য কোন মাস বা দিন-কাল নির্দিষ্ট করা বিদ্আত (ফাতওয়ায়ে আযীযী-১৭৬)। তিনি তুহ্ফায়ে ইসনা আশারিয়া নামক গ্রন্থে মীলাদ উদযাপনকে শিয়াদের মুহাররম উদযাপনের সাথে তুলনা করে বলেন, “শিয়াদের সাদৃশ্য অবলম্বন থেকে দরে থাকা আবশ্যক (মাহনামায়ে দারুল উলূমজানুয়ারী সংখ্যা১৯৮৯ইং)
৫) ইমাম আহ্মদ ইব্নে মুহাম্মদ মালেকী (রাহ্.) বলেন, “চার মাযহাবের আলেমগণ মীলাদ অনুষ্ঠানের নিন্দায় একমত (আল্ কাওলুল মুতামাদআল্ মিনহাযুল ওয়াযিহ্-২৫৩)
৬) মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও মুফাস্সির আল্লামা সৈয়দ রশীদ রেজা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “এই মীলাদ নির্দ্বিধায় বিদ্আত কাজ। জনৈক বাদশা এর উদ্ভাবক (হিওয়ার মাআল মালেকী-১৭৬)
৭) সৌদি আরবের প্রধান মুফ্তী আল্লামা শায়েখ আব্দুল আযীয বিন বায এর ফাত্ওয়াঃ তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কুরআনসুন্নাহ্ তথা অন্যান্য শরয়ী দলীল মতে ঈদে মীলাদুন্নবীর আয়োজন-অনুষ্ঠান ভিত্তিহীনবরং বিদ্আত। এতে ইহুদী-খ্রীস্টানদের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এসব অনুষ্ঠানে মুসলমানদের যোগদান করা নাজায়েয। কেননাএর দ্বারা বিদ্আতের সম্প্রসারণ ও তদপ্রতি উৎসাহ যোগানো হয় (মাজমুউ ফাতওয়া-৪/২৮৩-৮৪)

ঈদে মীলাদের নিন্দনীয় দিকসমহঃ
১) মীলাদ সমর্থক আলেমগণ কেবল যে ঈদে মীলাদের অনুষ্ঠান করেন তা নয়বরং যারা এসব নবোদ্ভাবিত বিষয় পালন করে নাতাদের প্রতি গালমন্দের একটা কোষ সৃষ্টি করেন এবং তাদেরকে ওহাবীনবীর শত্রু ইত্যাদি তিরস্কারে জর্জরিত করেন। যদি ব্যাপার তাই হয়তবে সাহাবী,তাবিঈনইমাম আবু হানিফাইমাম মালেকইমাম বুখারীইমাম গজ্জালীআরিফে রূমীবড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীখাজা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী (রাহ্.) প্রমুখ কোন ইমাম বা বুযুর্গ এই তিরস্কার থেকে বাঁচতে পারেন না। কারণতাঁদের যুগে ঈদে মীলাদের অনুষ্ঠান পালিত হত না। তাছাড়া হাদীস অনুযায়ী মুসলমানদের গালমন্দ করা যে ফাসেকী এবং সম্মানহানি করা যে হারামতা কি আদৌ চিন্তা করা হয়। এ ধরনের অহেতুক বিবাদ-বিসম্বাদের ফলে মুসলিম ঐক্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়তজ্জন্য তারা কি দায়ী নয়?
২) মীলাদপন্থী আলেমদের অনেকে মীলাদ মাহ্ফিলে রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাজির-নাজির মনে করেন এবং এই ধারণা ব্যাপক করার চেষ্টা চালান। অথচ শরীয়ত ও যুক্তি উভয় দিক দিয়ে এ ধারণা অসত্য ও বাতিল। ফিক্বাহ্ শাস্ত্রবিদগণ এমন আক্বীদা পোষণকারীদেরকাফির সাব্যস্ত করেছেন। কারণহাজির-নাজির হওয়া কুরআন-হাদীসের আলোকে মহান আল্লাহর একটি বিশেষ গুণযা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্য হতে পারে না
৩) ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের অন্যতম নিন্দনীয় দিক হল এতে বিজাতির সাদৃশ্যতা অবলম্বন এবং তাদের অনুকরণ দেখা যায়যা হাদীসের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ। কেননাএই রসম খ্রীস্টান ও হিন্দুদের থেকে মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে। খ্রীস্টান জাতি প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর হযরত ঈসা (আ.)এর জন্ম দিবস পালন উপলক্ষ্যে ক্রিসমাস ডে-এর আয়োজন করে। জনৈক বেরলবী মৌলবী ঈদে মীলাদ পালনের বৈধতা ব্যাখ্যা করে বলেনমহাসমারোহে ঈসা (আ.)এর জন্ম দিবস যে দেশে পালিত হয়সে দেশে ইসলামের ইমেজ প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিতভাবে নবী দিবস পালন করা আবশ্যক। যাতে ইহুদী-নাসারাদের অন্তরে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)এর মর্যাদা বদ্ধমল হয় এবং মুসলিম যুব সমাজের অন্তরেও নবীজির প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টি হয় (দৈনিক জং১২ মার্চমাহনামায়ে দারুল উলূমএপ্রিল সংখ্যা ১৯৯০ইং)
হিন্দুরাও প্রতি বছর ৮ ভাদ্র শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে জন্মাষ্টমী পালন করে থাকে। এ উপলক্ষ্যে বিরাট জুলুস-মিছিলের আয়োজন করে
৪) প্রচলিত মীলাদ মাহ্ফিলের আর একটি নিন্দনীয় কাজ হলতথায় শ্রোতাবৃন্দের চিত্তাকর্ষণ উদ্দেশ্যে এমন সব আজগুবী কিচ্ছা-কাহিনী ও বানোয়াট হাদীস বয়ান করা হয়যা নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রন্থসমহে পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতপবিত্র জীবনের যে অজস্র ঘটনা বিশুদ্ধ সনদে হাদীস গ্রন্থসমহে বর্ণিত আছেতার প্রত্যেকটিই চমকপ্রদ এবং উম্মতের জন্য শিণীয়। তদসত্ত্বেও মীলাদ পাঠকারী মৌলবীগণ সেই বিশুদ্ধ ও শিণীয় ঘটনাগুলো পাশ কাটিয়ে বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী ও জাল হাদীস শুনিয়ে নিজেদের ইল্ম জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কঠোর সতর্কবাণী বিদ্যমান। মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে তিনি ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে আমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করেসে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা করে নেয়

জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন ইসলামী মল্যবোধ পরিপন্থীঃ
বিখ্যাত আলেম ও বিশিষ্ট লেখক মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী (রাহ্.) বলেন, “আসলে আগেকার জাতিগুলোর মধ্যে তাদের ধর্ম প্রবর্তক ও মহাপুরুষগণের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালনের রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। যেমন খ্রীস্টানরা অদ্যাবধি হযরত ঈসা (আ.)এর জন্ম দিবস পালন করে আসছেকিন্তু ইসলামী শরীয়ত দিবস পালন-এর কোন প্রথা প্রবর্তন করেনি। না করার মধ্যে দু’টি হিকমত নিহিত। প্রথমদিবস পালনে যা কিছু করা হয়তা ইসলামের দাওয়াততার রূহ্ ও চরিত্রের সাথে কোন প্রকার সঙ্গতি রাখে না। বস্তুতঃ ইসলাম এই জাহেরী সাজসজ্জারং-তামাশা ও শ্লোগানে বিশ্বাসী নয়। ইসলাম এসব হৈচৈ ও রিয়াকারী হতে দরে থেকে নীরবতার সাথে মানুষের ভাবান্তর ঘটায়অতঃপর বিশুদ্ধ আক্বীদাসুন্দর স্বভাব-চরিত্র ও নেক আমলের তরবিয়ত দিয়ে মানুষকে মানুষে পরিণত করে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে এসব জাঁকজমক কোন মল্য রাখে না। দ্বিতীয় হিকমত হল,অপরাপর ধর্মের মত ইসলাম বিশেষ কোন মৌসুমে পল্লবিত হয় নাবরং এ বৃ সদা বসন্তের ন্যায় সারা বছর তরতাজা থাকে এবং সর্বদা এর ফল-ফুল আহরণ করা যায়। তাই ইসলামের দাওয়াত কোন দিন তারিখে সীমাবদ্ধ নয়
অপরাপর জাতিসমহ তাদের দুচারজন মহাপুরুষের জন্ম দিবস পালন করে ক্ষান্ত হয়ে যায়। কিন্তু ইসলামের কথা ভিন্ন। ইসলামের রয়েছে অগণিত ব্যক্তিত্বযাঁদের আযমত ও মহত্বের সামনে আসমান নতশিররানী ফেরেশ্তাগণের পবিত্রতা নিষ্প্রভ। ইসলামের অসংখ্য নবী-রাসলের কথা প্রথমে আসে,যাঁরা ছিলেন মানবতার দিশারী। নবীগণের পরে আসে লাধিক সাহাবায়ে কিরামের কাফেলা। এরপর আসে প্রতি শতাব্দীর ল ল আউলিয়া ও গাউস-কুতুবের জামাআত। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন হিদায়াতের উজ্জ্বল নত্র। এবার চিন্তা করে দেখুনজন্ম দিবস পালনের প্রথা যদি ইসলাম জারি করে দিততবে সারা বছরে উম্মতের জন্য নিজস্ব কাজের একটি দিনও কি অবশিষ্ট থাকতএ জন্য রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীতাবিঈন থেকে শুরু করে ৬শ হিজরী পর্যন্ত কোন উম্মত দিবস পালনের বিজাতীয় প্রথাকে গ্রহণ করেননি

কিসের আনন্দে এ উৎসবঃ
বড় অবাক হওয়ার কথারাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবীউল আউয়াল মাসের কোন্ তারিখ জন্মগ্রহণ করেছিলেনসে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মতভেদ আছেকেউ বলেন ৩ তারিখ,কেউ বলেন ৮ তারিখকেউ বলেন ৯ তারিখআবার কেউ বলেন ১২ তারিখ। কিন্তু অনেক ইতিহাসবিদের মতে ১২ রবীউল আউয়াল তিনি ইন্তিকালও করেছেন। তাহলে বলা যাবে যেআমরা মীলাদুন্নবীর উৎসব পালন করি সে দিন যে দিন তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করেরবীউল আউয়ালের ১২ তারিখ তোমরা যে উৎসব পালন করতা কি নবীর জন্ম দিবস হিসেবেনা তাঁর ইন্তিকালের আনন্দে? (নাঊযুবিল্লাহ্) তবে এর সদুত্তর হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না
পরিশেষে বলতে হয় যেরাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম বৃত্তান্ত ও সীরাত-চরিতের বর্ণনা এবং তাঁর প্রেম-ভালবাসার প্রকাশ এক কথাআর প্রচলিত মীলাদ মাহ্ফিল বা জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী’র আয়োজন-অনুষ্ঠান অন্য কথা। প্রথমটি মুস্তহাববরং আবশ্যকীয়। আর দ্বিতীয়টি শরীয়ত ও যুক্তি উভয় দিক দিয়ে ভিত্তিহীন। ইসলাম ধর্মে এক নতুন বিষয়ের সংযোজন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রূহের অসন্তুষ্টির কারণ। যা শরীয়তের উসল অনুযায়ী পরিত্যাজ্য। হিদায়াত আল্লাহ্ তাআলার হাতে। # 
লেখকঃ হাদীস গবেষকবক্তাগ্রন্থ প্রণেতা এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস- দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম,হাটহাজারীচট্টগ্রাম

No comments:

Post a Comment