Saturday, 26 July 2014

ফাযায়েলে আমালে দুর্বল হাদীস আছে, তাই এ কিতাবটি কেন পরিত্যাজ্য নয় ...

উত্তর :



মুহাদ্দিসীনে কেরামের মূলনীতি হল দুর্বল হাদীস ফাযায়েলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।



যেমন-



সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী রহঃ বলেন-

قال العلماء من المحدثين والفقهاء وغيرهم يجوز ويستحب العمل فى الفضائل والترغيب والترهيب بالحديث الضعيف ما لم يكن موضوعا (الأذكار-৭-৮



মুহাদ্দিসীন ও ফুক্বাহায়ে কেরাম এবং অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম বলেন-দুর্বল হাদীসের উপর ফাযায়েল ও তারগীব তথা উৎসাহ প্রদান ও তারহীব তথা ভীতি প্রদর্শন এর ক্ষেত্রে আমল করা জায়েজ ও মুস্তাহাব। যখন উক্ত হাদীসটি জাল না হয়। {আল আজকার-৭-৮}



এ মূলনীতিটি নিম্ন বর্ণিত বিজ্ঞ ব্যক্তিগণও বলেছেন-



১- মোল্লা আলী কারী রহঃ-মওজুয়াতে কাবীর-৫, শরহুন নুকায়া-১/৯

২- ইমাম হাকেম আবু আব্দুল্লাহ নিশাপুরী রহঃ-মুস্তাদরাকে হাকেম-১/৪৯০

৩- আল্লামা সাখাবী রহঃ- আল কাওলুল বাদী’-১৯৬

৪- হাফেজ ইবনে তাইমিয়া হাম্বলী রহঃ- মাজমুআ ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া-১/৩৯

আহলে হাদীস নামধারী গায়রে মুকাল্লিদগণও এ মূলনীতিতে একমত

১- শায়খুল কুল মিয়া নজীর হুসাইন সাহেব দেহলবী রহঃ- ফাতওয়া নজীরিয়া-১/২৬৫

২- নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান- দলীলুত তালেব আলাল মাতালিব-৮৮৯ {নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান সাহেবকে গায়রে মুকাল্লিদদের আকাবীরদের অন্তর্ভূক্ত হিসেবে ধর্তব্য করা হয়।

{আপকি মাসায়েল আওর উনকা হল কুরআন ওয়া সুন্নাত কি রওশনী মে, লেখক-মুবাশশির আহমাদ রাব্বানী-২/১৮১}

৩- মাওলানা সানাউল্লাহ ওমরতাসরী রহঃ- আখবারুল হাদীস-১৫ শাওয়াল ১৩৪৬ হিজরী।

৪- হাফেজ মুহাম্মদ লাখওয়ী রহঃ- আহওয়ালুল আখরাস-৬

৫- মাওলানা আব্দুল্লাহ রূপরী সাহেব রহঃ- ফাতওয়া আহলে হাদীস-২/৪৭৩



বিখ্যাত ফকিহ ইমাম ইবন হুমাম (র:) লিখেছেন " জইফ হাদীস যা মউজু নয়, তা ফজিলত অর্জনের জন্য আমল করা যায়।(ফাতহুল কাদীর)



মোল্লা আলী কারী বলেন, "সকলেই একমত যে, জইফ হাদীস ফজীলত হাসিল করের জন্য আমল করা জায়ীজ আছে।"

যে ক্ষেত্রে জইফ হাদীস পাওয়া যাবে, সেক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই কিয়াস হালাল নয়। তাই ইমামগণ প্রত্যেকে বাক্তিগত রায়-এর উপর জইফ হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েছেন।



ইমাম আবু হানিফা'র বাণী "হুজুরে পাক (সা:) হতে বর্ণিত হাদীস যদিও তা রাবীদের কারণে জইফ হয়, ওটা কিয়াস হতে উত্তম।যে ক্ষেত্রে জইফ হাদীস পাওয়া যাবে, সেক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই কিয়াস হালাল নয়" ( মুকাদদিমা এলাউস সুনান)



যয়ীফ সনদে বর্ণিত রেওয়ায়াত আমলযোগ্য হওয়ার মানদন্ড:-



১।

ইমাম বদরুদ্দীন যারকাশী রহঃ তাঁর উসূলে হাদীসের কিতাব 'আননুকাত' এ লেখেন-

"যয়ীফ হাদীস যখন ব্যাপকভাবে উম্মাহর(মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের) কাছে সমাদৃত হয় তখন তার উপর আমল করা হবে-এটাই বিশুদ্ধ কথা।এমনকি তখন তা হাদীসে মুতাওয়াতির(বিপুলসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) হাদীসের পর্যাযে পৌঁছে যায়।"-আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ ১/৩৯০



২।

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ লেখেন-

"হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি হল,ইমামগণ তার বক্তব্যের উপর আমল করতে একমত হওয়া।এক্ষেত্রে হাদীসটি গ্রহণ করা হবে এবং এর উপর আমল অপরিহার্য হবে।উসূলের অনেক ইমাম এ বিষয়টি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন।"-আননুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ ১/৪৯৪



৩।

মুরসাল বর্ণনার সমর্থনে উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা বিদ্যমান থাকলে তা গ্রহনযোগ্য হওয়ার ব্যপারে ইমামগন একমত।এখানে শুধু শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ এর বক্তব্যটিই উদ্ধৃতি করছি যাকে গায়েরে মুকাল্লিদরা 'আপন মানুষ' মনে করেন-

"যে মুরসালের অনুকূলে অন্য কিছু পাওয়া যায় কিংবা পূর্বসূরিগণ যার অনুসরণ করেছেন তা ফকীহগণের সর্বসম্মতিক্রমে দলীল হিসেবে গ্রহণীয়।"-ইকামাতুদ দলীল আলা বুতলানিত তাহলীল,আলফাতাওয়াল কুবরা ৪/১৭৯।



আরো দেখুন তাঁরই কিতাব মাজমূউল ফাতাওয়া ২৩/২৭১;মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যা ৪/১১৭



সুতরাং গায়েরে মুকাল্লিদরা যদি হাদীসের ইমামগণের অনুসরণ করে 'যয়ীফ বা মুরসাল' বলে থাকেন তাহলে সেই ইমামদের নীতি অনুসারেই যয়ীফ রেওয়ায়াতকে(যা শুধু সনদের বিবেচনায় যয়ীফ) অবশ্যই আমলযোগ্য স্বীকার করে নিতে হবে;যদি তারা তা স্বীকার না করে তবে রেওয়ায়াতটিকে যয়ীফ বলার কোনো অধিকারই তাদের নাই।

অতএব এমন রেওয়াত যার সনদটা শুধুমাত্র যয়ীফ/মুরসাল,কিন্তু মান ও এর বক্তব্য সাহাবা যুগ থেকে নিয়ে গোটা উম্মাতের আমলের মাধ্যমে অনুসৃত;তার বিপরীতে কেবল যারা মারফু মারফু বলে চিল্লায় তারা মূলত হাদীস অস্বীকার করার মতলববাজি করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্যই নাই।



শায়েখ জাকারিয়া রহঃ ও এ মূলনীতির কথা বলেছেন-



“এ বিষয়ে সতর্ক করাও জরুরী যে, হযরত মুহাদ্দিসীন রাঃ গণের নিকট ফাযায়েলের বর্ণনায় অনেক সুযোগ আছে। আর মামুলী দুর্বলতা গ্রহণযোগ্য। তবে সুফীয়ায়ে কেরামের ঘটনাতো ঐতিহাসিক বিষয়। আর এটা জানা কথা যে, ঐতিহাসিক বিষয় হাদীসের মর্যাদার তুলনায় খুবই কম।

{ফাযায়েলে আমাল, উর্দু এডিশন-৩৮৪, রেসালায়ে ফাযায়েলে নামায, তৃতীয় অধ্যায়, ফাযায়েলে আমাল পর ইশকালাত আওর উনকা জাওয়াব নম্বর-৬৫, ফাযায়েলে দরূদ-৫৬}



যে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসীনরা স্বীয় কিতাবে ফাযায়েলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস এনেছেন



১- ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ স্বীয় কিতাব “আস সুন্নাহ” এর মাঝে ৩০৩টি।

২- ইমাম বায়হাকী রহঃ “কিতাবুল আসমাই ওয়াস সিফাত” গ্রন্থে ৩২৯টি।

৩- ইবনে তাইমিয়া রহঃ তার “আল মুনতাকা” গ্রন্থে ২৬২টি।

৪- হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ তার “বুলুগুল মারাম মিন আদিল্লাতিল আহকাম” গ্রন্থে ১১৭টি।

৫- ইমাম নববী রহঃ তার খুলাসাতুল আহকাম মিন মুহিম্মাতিস সুনান ওয়া কাওয়ায়িদিল ইসলাম” গ্রন্থে ৬৫৪টি।

৬- মুহাম্মদ ইবনে খুজাইমা রহঃ তার “কিতাবুস সিহাহ” গ্রন্থে যা সহীহ ইবনে খুজাইমা নামে প্রসিদ্ধ এনেছেন-৩৫২টি।

৭- মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান রহঃ তার “কিতাবুস সিহাহ” যা সহীহ ইবনে হিব্বান নামে প্রসিদ্ধ, তাতে এনেছেন-২৯৪টি।

৮- ইমাম দারা কুতনী রহঃ তার “সুনানে দারা কুতনী” তে অনেক দুর্বল হাদীস এনেছেন বলে মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন।

৯- গায়রে মুকাল্লিদদের ইমাম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খানও তার “কিতাবু নুজুলিল আবরার” নামক গ্রন্থে ১৩৩টি দুর্বল হাদীস এনেছেন।

 আল্লাহ তায়ালা আমাদের কুরআন ও সুন্নাহ অনুসারে আমল করার তৈফিক দান করুন। আমিন। 

No comments:

Post a Comment